সন্ধ্যাতেও বৃষ্টি বন্ধ হল না। নন্দা টিভি-র খবর থেকে শুনল, বারিপদার থেকে নিম্নচাপ উত্তর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে কলাইকুন্ডার কাছে অবস্থান করছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত গত চব্বিশ ঘণ্টায় ১৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে শুক্রবারও সারাদিন জোর বৃষ্টি ও দমকা বাতাস চলবে তবে সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমতে পারে।
শুক্রবার বৃষ্টি কমার বদলে আরও বেড়েই গেল। খবরের কাগজওয়ালা পর্যন্ত আসতে পারেনি যখন, নন্দা বুঝল রাস্তায় অন্তত কোমরের উপর জল উঠেছে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে সে বিরক্ত হয়ে পড়ল। সাত মাসের ছেলের সঙ্গে কতক্ষণ আর কথা বলা, খেলা করা যায়! সময় কাটাতে সে ফোন করল তার বাপের বাড়িতে। এত বৃষ্টিতেও ফোন কাজ করছে। দেখে সে অবাকই হল। ভাই জানাল, একতলা থেকে জিনিসপত্র দোতলায় তুলে আনা হচ্ছে, তারা এখন খুব ব্যস্ত।
ফোন রেখে নন্দা কী ভেবে নীচে এল। ডাইনিং টেবিলের ধারে মেঝেয় বুড়োবুড়ি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। তাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল।
তোমাদের ঘরে কি জল ঢুকেছে?
দুজনেই মাথা নাড়ল।
জিনিসপত্র এখানেই নিয়ে এসো।
টিভিতে সন্ধ্যার খবরে সে শুনল আজ আলিপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সারাদিনে ২৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে কলকাতায়। শনিবারও বজ্রবিদ্যুৎ-সহ কয়েক পশলা জোর বৃষ্টি হতে পারে।
রাত্রে একতলায় ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতে নন্দা দেখল ঘরের কোনায় একটা টিনের সুটকেস আর ভিজে কাপড়। পোঢ় কার্ড আকারের একটা বাঁধানো ছবি উপুড় করে শুকোতে দেওয়া হয়েছে। ছবির পিছনের হলদে রঙের কাগজের বোর্ডটা ভিজে ফুলে উঠেছে। সে ধরে নিল ছবিটা মা কালীর অথবা শ্রীকৃষ্ণের।
শনিবার সকালেই বৃষ্টি ঝিরঝিরে হয়ে এল। দুপুরে প্রায় বন্ধই। তা হলেও আকাশ থমথমে, ঘন মেঘে ছেয়ে আছে। রাস্তায় লোক চলছে না, গাড়ি তো নয়ই। দুটো কাক সামনের বাড়ির কার্নিশে বসে। তা ছাড়া সে আর কোনো জনপ্রাণীও দেখতে পেল না।
টেলিফোন বেজে উঠল।
হ্যালো, কে দিদি? কী অবস্থা যে…
নন্দা বড়ো বিপদ, শিগগিরি তুই সতুদের…আমার দেওর সতুদের বাড়িতে একটা খবর দেবার ব্যবস্থা কর, যেভাবেই হোক। ওর ছেলে মাস্তু পাঁচ দিন হল আমাদের বাড়িতে রয়েছে। আজ সকালে চুপিচুপি কখন যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে কেউ লক্ষ করিনি। আট বছরের ছেলে। রাস্তাঘাট জলে থইথই। সকাল থেকেই খোঁজাখুঁজি করছি আমরা। এইমাত্রপাশের বাড়ির একজন খবর দিল, রাস্তার পাশে ড্রেনের মধ্যে একটা ছেলের বডি পাওয়া গেছে। জলে ডোবা। বয়সও বেশি নয়। হাসপাতালে নিয়ে গেছে। শুনেই সবাই আর জি কর এ রওনা হয়ে গেছে। তুই এক বার ওদের বাড়িতে খবর দেবার ব্যবস্থা কর। পরের ছেলে বাড়িতে এনে একী বিপদে পড়লাম।
নন্দা কান্নার শব্দ পেল। খবরটা শুনে সেও স্তম্ভিত। মাকে সে দেখেছে। ওরা কাছাকাছি থাকে। হেঁটে মিনিট পনেরো-কুড়ির পথ। মাস দুয়েক আগেই ওরা নন্দার ছেলেকে দেখতে সন্ধ্যে বেলায় এসেছিল। সঙ্গে মান্তুও ছিল। ছটফটে চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে। একদন্ডও বসে থাকতে পারে না।
নন্দা, যদি সম্ভব হত তা হলে আমি এখুনি বেলগাছিয়া থেকে দৌড়ে যেতুম। রাস্তায় বুক সমান জল, একটা গাড়ি নেই। ওদের এখুনি খবর না দিলে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকব। তুই একটা ব্যবস্থা কর। আমার প্রেশার বাড়ছে। আর কথা বলতে পারছি না হাত-পা কাঁপছে, বুকের মধ্যে কী যে হচ্ছে! তোর বাড়ি থেকে তো আর বেশি দূর নয়।
আচ্ছা আমি দেখছি। তুমি ব্যস্ত হোয়য়া না।
ফোন রেখে নন্দা নীচে নেমে এল। বুড়োবুড়ি দুজনে পাশাপাশি বসে সদর দরজায়। সিঁড়ির প্রথম ধাপটা জলের নীচে। ওরা জলের দিকে তাকিয়ে। নন্দাকে দেখে উঠে দাঁড়াল।
ভূপতি, ভীষণ বিপদে পড়েছে আমার দিদি। তোমাকে এখুনি একটা কাজ করতে হবে।
ভূপতি তার ভালো চোখটা দিয়ে স্তিমিত চাহনিতে তাকিয়ে। শীর্ণ গলার কণ্ঠটা কয়েক বার ওঠা নামা করল। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হয়েছে। সকাল থেকে খায়নি।
নন্দা ঝড়ের বেগে কথাটা বলে গেল। ওরা দুজন তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। এক বার শুধু নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল যখন নন্দা বলল, শেষ দেখাটা অন্তত তা হলে ওরা দেখতে পাবে। যাবে তুমি?
ভূপতি বউয়ের মুখের দিকে তাকাল।
যাব। বলাইয়ের মা শান্ত মৃদুস্বরে বলল।
একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি তাহলে, মুখে আর কিছু তোমাকে বলতে হবে না। বাড়ির ঠিকানা তোমাকে বলে কোনো লাভ নেই, মনে থাকবে না। তবু লিখে দিচ্ছি। কোনো লোককে দেখালে বাড়ি বলে দেবে। আমি তোমাকে বরং জায়গাটা বুঝিয়ে দিচ্ছি, সেইমতো চলে যাও। খুব শক্ত হবে না খুঁজে বার করতে।
মিনিট দশেক পর গেট খুলে ভূপতি রাস্তার দু-দিকে তাকাল। বৃষ্টি আপাতত ধরে গেছে। দূরে একটি লোককে সে দেখল রাস্তা ধরে আসছে টলতে টলতে। তার কোমর থেকে দেহ জলের নীচে। বলাইয়ের মা গেট পর্যন্ত সঙ্গে এসেছে, নন্দাও।
ভূপতির হাতে ছাতা, জামার বুকপকেটে চিঠি। সে পা ঘষড়ে এগিয়ে পাথরের কিনারে পোঁছে, সন্তর্পণে ইঞ্চি ছয়েক নীচে রাস্তায় নামল। জলে স্রোত রয়েছে। কাছেই একটা বড়ো পুকুর আছে, জলের টান সেই দিকে। কয়েক পা টানের বিরুদ্ধে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছন ফিরে বউয়ের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল।
বলাইয়ের মা উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়েছিল। স্বামীর চাহনি থেকে কী বুঝে নিয়ে সেও জলে নামল। মুখ ফিরিয়ে নন্দাকে শুধু বলল, আমি সঙ্গে যাচ্ছি। ওর শরীরটা ভালো নয়।