কী রে ব্যাটা, মরতে চাস? তোর প্রাণ এখন আমার হাতে, তা কি জানিস?
বলার পরই সত্যেন অদ্ভুত একটা মজা বোধ করল। প্রাণ এই ছোট্ট শব্দটা ঝনঝন শব্দে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বজ্রের মতো গড়িয়ে নেমে গিয়ে আবার উঠে এল। এই কুকুরটারই হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সেদিন যেমন সে ভয় পেয়ে গেছল, অনেকটা সেইরকম একটা আতঙ্ক এখন তাকে যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই এখন সে আবার খুন করতে পারে, কেউ জানবে না, বুঝতে তো পারবেই না। একটা প্রাণ এখন তার হাতে। তারই দয়ার উপর! অদ্ভুত তো?
বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। ইতিমধ্যে জল রকে উঠে পায়ের গোছ এবং জুতো যে ডুবিয়ে দিয়েছে সে-হুশ তার ছিল না। পেটে নখের অধৈর্য আঁচড় সুড়সুড়ি দেবার মতো লাগছে। সত্যেন কেকের টুকরোটা একটু নামিয়েই আবার তুলে নিল। কুকুরটা কাতরানির মতো শব্দ করে ডেকে উঠল।
হুঁহুঁ বাব্বা, এটা টপাস করে ফেলব আর কপাৎ করে গিলবি, সেটি হচ্ছে না। ভাগ ভাগ। সত্যেন তালু দিয়ে ওর মুখে সজোরে ধাক্কা দিল। টাল খেয়ে কুকুরটা পা দুটো নামিয়ে নিয়েই চাপা গজরানির মতো শব্দ করল।
ওসব ফোতো রাগ আমাকে দেখালে এমন লাথ কষাব-না… তোকে বাঁচিয়ে রাখছি আর শালা আমাকেই কিনা… সত্যেন লাথি ছোঁড়ার জন্য পা তুলে টলে পড়ে যাচ্ছিল। দেয়ালটা ধরে নিজেকে সামলাচ্ছে তখন হাত থেকে কেকের টুকরোটা মেঝের জলের উপর পড়ে গেল। নীচু হয়ে সেটা সবে তুলেছে তখনই কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কবজির কাছে কামড়ে ধরল। ঝটকা দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিতেই কুকুরটা দ্বিতীয় বার আক্রমণ করে বাহু কামড়ে ধরতেই পিছিয়ে যেতে গিয়ে সত্যেন গড়িয়ে রক থেকে জলে পড়ল। কেকের টুকরোটা আবার হাত থেকে মেঝেয় ভাসছে।
রাস্তার আলোয় যতটুকু দেখা যায়, বাহুটা তুলে ফ্যালফ্যাল করে সে তাকিয়ে। সাদা হাড়ের আভাস যেন দেখা যাচ্ছে। খোদলটা ক্রমশ ভরে উঠছে রক্তে। পাঠশালার রকের উপর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে কুকুরটা মুখ নীচু করে চিবোচ্ছে। সত্যেন ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। জল হাঁটু ছাড়িয়ে গেছে। পালাবার জন্য নিজেকে টানতে টানতে সে জলের মধ্য দিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।
রাস্তায় হাঁটুর নীচে জল। টলতে টলতে সে এগোচ্ছে। বৃষ্টি প্রায় থেমেই গেছে। নিস্তব্ধ এবং জনশূন্য চারিদিক। সে এক বার পিছন ফিরে তাকাল। পাঠশালার রকে জলবন্দি হয়ে একটা অবয়ব নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে। সত্যেনের চোখ জলে ভরে উঠল। যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তার হাতে।
বৃষ্টির মতো
বৃহস্পতিবার মাঝরাতে জোলো হাওয়ার ঝাপটায় নন্দার ঘুম ভেঙে গেল। জানলা দিয়ে দেখল আকাশের রং মেটেলাল। দূরে রাস্তার আলোয় বৃষ্টির ধারা দেখে বুঝল সারারাতই ঝরবে। সাত মাসের ছেলে পাশেই ঘুমোচ্ছে। তার গায়ের চাদরটা টেনেটুনে দিয়ে সে উঠে বসল। দোতলায় জানলার পাল্লা মোট আঠারোটা। বন্ধ করে না দিলে দালান ঘর ভেসে যাবে। খাট থেকে নামার সময় সে জানলা বন্ধ করার শব্দ পেল।
কে বলাইয়ের মা নাকি?
হ্যাঁ।
ছোটাখাটো শীর্ণ চেহারা, বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। অর্ধেক চুলই পাকা। সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর। মাথায় সবসময়ই ঘোমটা। বলাইয়ের মা স্বল্পবাক, ধীর প্রকৃতির। ওর স্বামী ভূপতিও বেঁটে গড়নের। স্ত্রীর থেকে চুল বরং একটু কালোই, ষাট-পঁয়ষট্টির মধ্যে বয়স। মাঝে মাঝে হাঁপানির টান ওঠে। ওর একটা চোখের মণি ঘোলাটে। একদমই দেখতে পায় না। দুজনে থাকে গ্যারেজের লাগোয়া একটা ছোট্ট ঘরে।
জানলা বন্ধ করে বলাইয়ের মা নীচে নেমে যাচ্ছে। নন্দা বলল, গ্যারেজের শাটারের তলা দিয়ে জল ঢুকছে কি না একটু দেখতে বলো তো ভূপতিকে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নন্দা দেখল অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘলা আকাশ। ঘরের মধ্যে আবছা আবছা আলো। জানলা দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তাটা দেখে তার চক্ষুস্থির! ছুটে নেমে এসে দেখল বলাইয়ের মা বাসন মাজছে।
ভূপতি দুধ এনেছে কি? রাস্তায় যা জল জমেছে দুধের ভ্যান হয়তো নাও আসতে পারে!
এখনও ফেরেনি।
মিনিট দশেক পর ভূপতি ফিরে এসে জানাল, বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়ের গোছ ডোবা জল কিন্তু বড়ো রাস্তায় হাঁটুর কাছাকাছি। একটা দোকানও ভোলা নেই। দুধের গাড়িও আসেনি। পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির ফটক দিয়ে রাস্তার জল ঢুকে ইঞ্চি চারেক গভীর হ্রদের মাঝে বাড়িটাকে দ্বীপ বানিয়ে ফেলেছে।
কী গেরো বলোতো, বৃষ্টি থামলেই বাঁচি। বাজার তো বসবে না, একটাও কি দোকান খোলা নেই?
ভূপতি মাথা নাড়ল।
চালে ডালে খিচুড়ি বসাও, আর কী করা যাবে।
ভিজে জবজবে খবরের কাগজ দিয়ে গেছে। ওড়িশায় বারিপদার কাছে নিম্নচাপ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এর প্রভাবে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া আর কিছু বলা নেই। বলবেই-বা কী করে, মাঝরাতে বৃষ্টি শুরু হলে পরদিন কাগজে সে-খবর দেওয়া সম্ভব নয়। নন্দা গ্র্যাজুয়েট, বুদ্ধিমতী, বিবেচক। তার স্বামী রঞ্জন কাঠের ব্যবসায়ী। চার দিন আগে সে অসম গেছে। প্রায়ই তাকে বাইরে যেতে হয়।
বৃহস্পতিবার সারাদিন বৃষ্টি পড়ল। তার সঙ্গে দমকা বাতাস। নন্দা মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে রাস্তার অবস্থা দেখল। গাছপালা আর বাড়ির ফাঁক দিয়ে বহু দূরের রাস্তায় চলন্ত বাসের চালটুকু দেখা যায়। সে একটাও বাস দেখতে পেল না। গ্যারেজের শাটারের নীচে এক হাত জল। যদি জল ঢুকে থাকে তা হলে গাড়িটার এঞ্জিনের তলার দিকটা এতক্ষণে ডুবে গেছে। কী আর করা যাবে।