হঠাৎ তার শরীর শিরশির করে হাতের নোম খাড়া হয়ে উঠল। কেউ একজন রকে রয়েছে। বিদ্যুৎ চমকাতেই দেখল রকের একপ্রান্তে বসে আছে শয়তান। মুখটা তার দিকেই ফেরানো। সত্যেন থরথর করে উঠল। এক-পা পিছোতেই দেয়ালে পিঠ লেগে গেল।
কুকুরটা গা ঝাড়া দিল। ধোঁয়ার মতো জলের গুঁড়ো ওর লোম থেকে রাস্তার আলোয় ছিটকে বাষ্পের মতো উঠল। আর সত্যেনের মনে হল একটা অলৌকিক জীব তার সামনে। মুখটা ঘুরিয়ে সত্যেনের দিকে তাকিয়ে। চোখ জ্বলজ্বল করছে।
আমাকে কি চিনেছে? বুঝে গেছে কি পকেটে ওকে মারার বিষ রয়েছে? ওদের সিক্সথ সেন্স নাকি প্রখর! দৌড়, একদম নয়। তাহলে।
বৃষ্টির ছাট হাওয়ার দমকায় রকটায় আছড়ে পড়ল। কুকুরটা সরে এল সত্যেনের দিকে। আর সত্যেন পকেটে হাত ঢুকিয়ে কেকটা আঁকড়ে রইল। কুকুরটা আরও সরে এল। ভয়ে একটা কাতরানি তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতেই কুকুরটা মুখ তুলে তাকাল। অন্ধকারে চোখ দুটো জ্বলজ্বলে দেখাচ্ছে। সত্যেনের মনে হল, যদি দাঁড়িয়ে ওঠে তাহলে গলার কাছে ওর দাঁত পৌঁছোবে শয়তান মুখ তুলে তার গলা পর্যন্ত দূরত্বটা আন্দাজ করছে।
দুজনের মধ্যে হাত ছয়েকের ফাঁকা জায়গা। সত্যেন এখনও দু-হাত পিছিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাতে কী লাভ, কুকুরটাও তাহলে সরে আসবে। জল উঠতে উঠতে রকের প্রায় সমান সমান। অল্প বৃষ্টিতেই এই অঞ্চলে হাঁটুজল জমে আর এখন তো তোড়ে অন্তত পনেরো মিনিট হচ্ছে।
হঠাৎ প্রচন্ড ঝলসানি দিয়ে ডান দিকে হাউজিং-এর একটা টিভি অ্যান্টেনায় বাজ পড়ল। সত্যেনের মুখে গরম হলকা লাগল, চোখ বন্ধ করে ফেলে সে ঠকঠক কেঁপে উঠল আর ক্ষীণ আর্তনাদ করে কুকুরটা গুঁড়ি মেরে তার পায়ের কাছে সরে এল। দমকা হাওয়ার সঙ্গে জলের একটা ঝাপটা আসতেই সত্যেন পিছিয়ে যাবার জন্য পা সরাতেই মাড়িয়ে ফেলল কুকুরের পা। তার বুকটা হিম হয়ে গেল কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। অবধারিত এইবার দাঁতগুলো বসবে তার গোছের কিংবা হাঁটুর কাছে। একটা মোচড় দিয়ে এক খামচা মাংস তুলে নেবে। দাঁতে দাঁত চেপে, দু-হাত মুঠো করে সে তৈরি। তাকে এবার কামড়াবেই, এই সময় আবার একটা বিদ্যুতের ঝলসানি হতেই সে মা গো বলে দু-হাতে কান ঢাকল এবং দেয়ালের দিকে মুখ ফেরাল। আগেরটার থেকে কিছুটা দূরে এবারের বাজটা পড়ল। কুকুরের কুঁই কুঁই কাতরানি তার কানে এল।
বিমূঢ়ত্বটা কেটে যেতেই দেখল কুকুরটা তার দু-পায়ের ফাঁকে প্রায় মুখটা গুঁজড়ে। এবার সে সরে যাবার চেষ্টা করল না। তার মনে হচ্ছে, কুকুরটা তাকে আক্রমণ করবে না। আরও মনে হচ্ছে, কুকুরটা ভয় পেয়ে তার কাছ থেকে বোধ হয় ভরসা চাইছে।
সত্যেনের স্নায়ুগুলো ঢিলে হয়ে গেল। বিরক্ত হল সে নিজের উপর। কেন যে মরতে এই পাঠশালার রকে উঠলাম! নয় একটু ভিজতামই, তবু সোজা বাড়ি চলে গেলেই ভালো হত। এই বৃষ্টি কখন যে থামবে কে জানে। এরপর সে কুকুরটার দিকে ঘাড় নীচু করে তাকাল। এটাই-বা এখানে কেন! বস্তির যেকোনো ঘরেই তো গিয়ে ঢুকতে পারত। নাকি তার মতোই ভেবেছিল, বৃষ্টি তো কিছুক্ষণ বাদেই ধরে যাবে, ততক্ষণ বরং এই রকে আশ্রয় নেওয়া যাক। নীচু জমির বস্তিতে এখন আর দাঁড়াবার মতো ডাঙা থাকা সম্ভব নয়।
সত্যেন দ্বিধায় পড়ল। বাড়ির দিকে এখনই রওনা হবে না কি আর একটু অপেক্ষা করে দেখবে। চোখ কুঁচকে মুখ তুলে একদৃষ্টে সে বৃষ্টির চাদরের দোলা দেখছে। মেঘ ভেদ করে দপ দপ করল লালচে বিদ্যুৎ। গুম গুম চার-পাঁচটা শব্দ গড়িয়ে গেল আকাশ দিয়ে। ভয় পাওয়ার মতো কিছু তাতে নেই। মেঘটা সরে যাচ্ছে বাজ ফেলতে ফেলতে।
চমকে পা সরিয়ে নিল সে। কুকুরটা চেটে দিয়েছে।
অ্যাই, ধ্যাত ধ্যাত। সত্যেন ধমকে উঠল, পা ঠুকল এবং জুতোর ডগা দিয়ে মুখটা সরিয়ে দিল। ব্যাটা ভয় পেয়েছে। এখন তাকে কাছে রাখার জন্যই এইসব চাটাফাটা…শালা শয়তান! সত্যেনের মাথা গরম হয়ে উঠল। মনে থাকে না মানুষকে কামড়াবার সময়? এখন যদি তোকে কেকটা দিই কী হবে? কপাৎ করে তো গিলে ফেলবি! নিজের মনেই সে গজগজ করে চলল। ব্যাটা কুত্তা, এতগুলো মানুষকে কামড়ে মাংস ছিঁড়ে নিয়েছিস, একটা লোক তোর জন্যই পা হারাতে বসেছে! আর শালা শয়তান, তুই কিনা সেই মানুষেরই কাছে কিঁউ কিউ করছিস ভয় পেয়ে?
ভাগ ব্যাটা। সত্যেন হঠাৎ লাথি কল পাঁজরে। এক-পা পিছিয়ে গেল কুকুরটা, ভীত শব্দ তুলে।
এইবার যদি তোকে খেতে দিই? সত্যেন পকেট থেকে কাগজে-মোড়া কেকের টুকরো বার করল। তুই তো খাবিই। হ্যাংলার জাত, যা পাবি তাই-ই তো খাস, এটা তো দারুণ জিনিস তোর কাছে। মোড়কটা ভিজে গেছে। কেকের সঙ্গে সেঁটে-যাওয়া কাগজ ছাড়াতে ছাড়াতে সে লক্ষ করল কুকুরটা মুখ তুলে তাকিয়ে লেজটা অল্প অল্প নাড়ছে।
ধীরে ধীরে কেকসমেত হাতটা সে পকেটে ভরে নিল। শয়তানটা বুঝতে পেরেছে এটা খাবার জিনিস।
কী রে, খাবি?
লেজটা জোরে জোরে নেড়ে কুকুরটা ছটফট করে উঠল। কু-কুঁ শব্দ বেরোচ্ছে মুখ থেকে। কোমর থেকে পিছনটা ঘন ঘন নড়ছে। সামনের পা দুটো অধৈর্যে তুলছে আর নামাচ্ছে। এগিয়ে এসে সত্যেনের গা ঘেঁষে মুখটা তুলে ছোট্ট করে তিন বার ডেকে উঠল। পকেট থেকে কেকের টুকরোটা বার করে সে হাতটা উঁচু করে তুলে ধরে রইল। কুকুরটা এবার দ্বিগুণ ছটফটানি শুরু করল।
এইবার? এইবার?
কুকুরটা হঠাৎ সামনের পা দুটো সত্যেনের পেটে ঠেকিয়ে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। তখন সে হাতটা আরও উঁচুতে তুলল।