দূর থেকেই দেখল বস্তির কয়েকটি শিশু রাস্তায় খেলা করছে। কয়েক জন বয়স্কা মেয়েমানুষ বসে গল্প করছে। কুকুর? সত্যেনের চোখ খুঁজে বেড়াল। রাস্তার নিয়ন আলোয় পাতাবাহারিগাছগুলোর নীচে একটা সাদা পুটলির মতো দেখেই তার মাথার মধ্যে রক্ত ছুটে এল। পেয়েছি একটাকে।
স্বাভাবিক কদমে হাঁটার চেষ্টা করেও তার পা জড়িয়ে আসছে। লক্ষ করল তাকে কেউ দেখছে কি না। শিশুরা ওই দিকটায় যাচ্ছে না দেখে সে আশ্বস্ত হল। পকেটে হাত দিয়ে কেক মোড়া কাগজটার সঙ্গে দেশলাইটাও পেল। আশ্চর্য, এটা ড্রয়ারে রেখে দিতে ভুলে গেছে!
সেই মাদি কুকুরটা। সত্যেনকে দেখেই মুখ তুলল।
আয়, আয়, চু-চু।
উঠে দাঁড়িয়েছে। কাগজের মোড়কটা খোলার সময় হাতটা এমনই কেঁপে গেল যে কেকের টুকরোটা রাস্তায় পড়ে গেল। নীচু হয়ে তুলতে গিয়েও তুলল না। যদি ছুটে এসে কামড়ে দেয়?
কিন্তু ছুটে এল না, বরং ল্যাজটা নাড়াল। তারপর সত্যেনকে স্তম্ভিত করে সে এগিয়ে এসে কেকের টুকরোটা এঁকেই মুখে তুলে চিবোতে শুরু করল। আর পায়ে পায়ে পিছিয়ে গিয়ে সত্যেন ভীত একটা আর্তনাদ করে প্রায় ছুটেই পালাতে লাগল।
বাড়িতে ঢুকতেই সুপ্রভার সঙ্গে মুখোমুখি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে সুপ্রভা অবাক স্বরে বলল, ভূত দেখেছ নাকি?
শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে সে শুয়ে পড়ল। রাত্রে খেল না, ঘুমোতেও পারল না। পরদিন অফিস যাবার সময় দেখল রাস্তা প্রতিদিনের মতোই স্বাভাবিক। বস্তির ভিতর থেকে ঝগড়ার আর কুকুরের ডাকের আওয়াজ পেল। কোথাও মরা কুকুরের চিহ্নও নেই। বুক থেকে একটা ভার নেমে যাওয়ার স্বস্তি নিয়ে সে অফিস পৌছোল।
একসময় মোহিতকে ডেকে সে জানিয়ে দিল, তোমার বিষে ভেজাল আছে। যা বলেছিলে সেইভাবেই একটাকে খাইয়েছি কিন্তু মরেনি। সত্যেন ড্রয়ার থেকে দেশলাই বাক্সটা বার করে টেবিলে রাখল। নিয়ে যাও এটা, যে দিয়েছে তাকে বোলো।
কবে খাইয়েছেন?
কাল সন্ধ্যার পর। রাস্তা থেকে নিজেই খেল। যতটা বলেছিলে ততটাই দিয়েছিলাম।
খোঁজ নিয়ে দেখুন মরেছে কি না, তারপর ফেরত নেব।
বাড়ি ফেরার সময়ও সে দেখল রাস্তা একইরকম। দু-তিনটে কুকুর ঘুরছে, এমনকী শয়তানটাকেও দেখতে পেল গ্রামোফোন রেকর্ডের কুকুরটার মতো বসে আছে বস্তিতে ঢোকার গলিটার কাছে। একটি লোক তার পাশে বসেই ঘুগনি খাচ্ছে। সত্যেন কার কাছে আর খোঁজ নেবে? বাড়িতে কাউকে এসম্পর্কে কিছু বলল না।
তবে সে শুনল, অরুণ দত্তর পায়ে পচ ধরেছে, খুব সিরিয়াস অবস্থা, পা কেটে-না বাদ দিতে হয়। পরের দিনই শয়তানটা কামড়াল কান্তি ঘোবের ভাইপোকে। বাড়িতে আত্মীয়রা এসেছিল। রাত হয়ে যাওয়ায় তাদের বাসে তুলে দিয়ে সে ফিরছে, তখন তাড়া করে কামড়ায়। তবে বস্তির একজন চেঁচিয়ে ওঠায় কামড়টা ভালোমতো দিতে পারেনি। চারটে সেলাই হয়েছে। শোনামাত্র সত্যেনের মাথা গরম হয়ে গেল।
কিন্তু সকালে ঠিকে ঝি একটা খবর দিল যেটা অপ্রত্যাশিত।
একটা কুকুর পরশু থেকে মরে পড়ে আছে হাউজিং-এর পিছনে পাঁচিলের গায়ে। দুর্গন্ধে ওদিককার ফ্ল্যাটের লোক টিকতে পারছে না। কর্পোরেশন আপিসে খবর দিয়েছে, এখনও কেউ আসেনি।
আর সন্দেহ নেই কোন কুকুরটা। মোহিত খাঁটি মানুষ, ভেজাল জিনিস সে গছাবে না। সত্যেন আবার উত্তেজনার মধ্যে পড়ে গেল। আবার একটা ঘোর তার শরীরে মনে লাগছে। তাহলে বিষটায় কাজ হয়েছে। তাহলে এবার শয়তানটাকে শেষ করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
বাসি কেকের টুকরোটা শক্ত হয়ে গেছে। আবর্জনার বালতিতে ফেলে দিয়ে সে স্থির করল, অফিসে মোহিতকে দিয়ে একটা কেক কিনে আনিয়ে নেবে। দেশলাই বাক্সটা ড্রয়ারেই রাখা আছে। অফিস ছুটির পর ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে তখন জিনিসটা তৈরি করে নেবে। আজই সন্ধের পর যদি সুযোগ মেলে, তাহলে আজই পৃথিবীতে ওর শেষ দিন!
বিকেল থেকেই মেঘ ঘনিয়ে আসে। দেরিতে ফিরবে বলে সত্যেন ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে কেকটা তৈরি করে অফিস থেকে যখন বেরোল তখন প্রথম বার বিদ্যুৎ চমকে উঠল। বাতাসে ঠাণ্ডা ভাব। বাসে ঠাসা ভিড়। বৃষ্টি নামার আগেই সবাই বাড়ি পৌঁছোতে চায়। সত্যেন ঠেলেঠুলে তার বাসে উঠল, তাকেও বৃষ্টির আগে পৌঁছোতে হবে। কিন্তু বাস থেকে নামার আগেই ফোঁটা ফোঁটা পড়ছিল। নামামাত্রই চড়বড়িয়ে বড়ো বড়ো ফোঁটায় শুরু হল। একটা কোনো আশ্রয় নেই যার তলায় দাঁড়ানো যায়। সত্যেন বাড়ির দিকে ছুটল।
মাঠটা পার হয়েই বুঝল ছোটাটা অর্থহীন। যে বেগে নামছে তাতে ভিজে ঢোল হয়ে যেতে হবে বাড়ি পৌঁছোনোর আগেই। পাঠশালার ঢাকা রকটা দেখে সে দৌড়ে বস্তির গলিতে ঢুকে রকে উঠে পড়ল। আর সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলসানির সঙ্গে প্রচন্ড শব্দে মেঘ ডাকল আর জলের ধারা প্রবল তোড়ে নামতে থাকল।
খুব বেঁচে গেছি। সত্যেন হাঁফ ছাড়ল। আর কয়েক সেকেণ্ড দেরি হলেই চুবিয়ে দিত। কপালের জল মোছার জন্য রুমাল বার করতে গিয়ে কেকের টুকরোটা হাতে ঠেকল। এটার আজ আর দরকার হচ্ছে না। এমন বৃষ্টিতে জানোয়ারও বেরোবে না।
বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। একই বেগে ঝরছে আর সঙ্গে হাওয়ার ঝাপটা। রাস্তার নিয়ন আলো ছাড়া চারিদিকে আর কোনো আলো নেই। সব বাড়ির জানলা বন্ধ। বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সে দেখতে পাচ্ছে নির্জন গলি। বৃষ্টিটা চাদরের মতো ঝুলে রয়েছে, দমকা বাতাসে চাদরটা নড়ে উঠলেই নিয়ন আলোর কণিকা ঝলমল করে উঠছে। সত্যেন মুগ্ধচোখে তাকিয়ে ছিল।