তিন দিন পর মোহিত তাকে একটা মোড়ক দিল দেশলাই বাক্সের মধ্যে। দাম নিল দশ টাকা।
খুব সাবধানে হাত লাগাবেন কিন্তু।… বড়ো কুকুর হলে এক চিমটেতেই কাজ হবে। মোটামুটি পাঁচ-ছটা মারার মতো মাল এতে আছে।
বাক্সটা পকেটে রেখে সত্যেন অস্বস্তিতে পড়ল। কীরকম একটা ভয় যেন সে পাচ্ছে। কীভাবে এটা খাওয়াবে? যদি বুঝে ফেলে খেতে না চায় আর তাকে যদি খুনিহিসাবে চিনে রাখে? জানোয়াররা নাকি এসব ব্যাপার ভালো বোঝে আর ওদের স্মৃতিশক্তিও নাকি দারুণ! জামাকাপড়ের বা গায়ের গন্ধ ওরা মনে রাখতে পারে বহুদিন। তা ছাড়া এটা খেয়ে যদি না মরে? হয়তো শুধুই পেটখারাপ হল, বমি করল, তারপর ঠিক হয়ে গেল। তখন তো আরও ডেঞ্জারাস হয়ে উঠবে। তবে মোহিত বাজেকথা বলার লোক নয়, পঁচিশ বছর ধরে ওকে সে দেখছে তো!
বাস থেকে নেমে মিনিট ছয়েক হেঁটে একটা মোড়ে পাঁচ-ছটি দোকান। সিগারেট-পানের, স্টেশনারির, মিষ্টির, তারপর মুদির দোকান। সত্যেন সস্তার একটা কেক মুদি দোকান থেকে কিনল। কিন্তু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাঠের মাটি ভিজে, রাস্তায় মাঝে মাঝে জল জমে। বস্তির লোকজন কেউ বসে নেই, একটা কুকুরও দেখতে পেল না।
সে একটু দমে গেল। তার মনে হল, মারতে হলে মনের ভিতরে একটা তীব্রতা না থাকলে কাজটা সম্পন্ন করা যায় না। খুনিরা এজন্যই মদটদ খেয়ে নিজেদের খেপিয়ে নিয়ে কাজে নামে। তবে ঠাণ্ডা মাথায়ও অনেকে খুন করে, স্বদেশিরা করত। ওদের একটা সংকল্প বা উদ্দেশ্য ছিল দেশপ্রেম, দেশকে স্বাধীন করা, অত্যাচার পীড়ন দেখে দেখে আর সয়ে সয়ে মহৎ আদর্শে উদবুদ্ধ হয়ে ওরা মারত, নিজেরাও মরত। সত্যেনের খুড়শ্বশুর ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে খুন করার চেষ্টা করেছিল। ধরা পড়ে ফাঁসিও হয়। তাঁর একটা ছবি শ্বশুরবাড়ির বৈঠকখানার দেয়ালে এখনও ঝোলানো আছে। খুবই মলিন তার কাচ ও ফ্রেম। প্রেরণা পাওয়ার মতো স্বচ্ছ নয়।
কিন্তু সত্যেন এই মুহূর্তে কুকুর মারার জন্য তীব্র ইচ্ছা অনুভব করছে না। কিন্তু এটা তার খুবই দরকার। সামনের বাড়ির অরুণ দত্তর এক-তলার জানলায় আলো জ্বলছে। সত্যেন বাড়িতে ঢুকে কলিং বেল টিপল। দরজা খুলল ঝি। ভিতরের ঘর থেকে উঁকি দিল অরুণ দত্তর বউ।
অরুণবাবু আছেন কেমন?
আজ বিকেলেই নার্সিংহোমে ভরতি হলেন। ধীর কিন্তু উদবিগ্ন স্বরে বলল। পা-টা খুব ভালো ঠেকছিল না। ডাক্তারবাবু সকালে দেখে বললেন, হয়তো অপারেশন করতে হতে পারে।
সত্যেন অবাক হবার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছে। অপারেশন কেন? পা কেটে বাদ দিতে হবে নাকি? কিন্তু একথা তো ওঁকে জিজ্ঞাসা করা যাবে না, তাহলে আরও ভয় পেয়ে যাবেন।
কী কান্ড দেখুন তো, এভাবে কুকুর কামড়ে মানুষের কত ক্ষতি করল। কত অর্থব্যয়, কত শারীরিক কষ্ট, আত্মীয়স্বজনদের দুশ্চিন্তা… কিছু-একটা করা দরকার। সত্যেন টের পাচ্ছে। সে উত্তেজনা অনুভব করছে। তা-ই নয়, অবলম্বনরূপে একটা উদ্দেশ্যও পাচ্ছে…কত ক্ষতি, কত কষ্ট! নিজের উদবেগ, সহানুভূতি ও কিছু সান্ত্বনা জানিয়ে সে বাড়ি ফিরে এল।
বিকেল থেকে সুপ্রভার শ্বাস ওঠায় সে রান্না করতে পারেনি। কোলে বালিশ নিয়ে বিছানায় বসে। বাবুল আটটার আগে অফিস ও আড্ডা থেকে ফেরে না। সত্যেন ভাত ফুটিয়ে, মাছের ঝাল বেঁধে রেখে কলঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে দরজা বন্ধ করল।
উবু হয়ে বসে সন্তর্পণে দেশলাই বাক্সটা খুলে দেখল-পাতলা কাগজে ওষুধের পুরিয়ার মতো ভাঁজ-করা। দু-আঙুলে টিপে বুঝল জিনিসটা পাউডারের মতো। ধীরে ধীরে সাবধানে ভাঁজ খুলে দেখল সাদা গুঁড়ো। গন্ধ শুকতে গিয়েও নাক তুলে নিল। নিশ্বাসের সঙ্গে যদি ভিতরে চলে যায়।
কেকটা কপাৎ করে খাওয়ার পক্ষে বড়োই, তাই দু-আধখানা করে নিয়েছে। পেরেক দিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করে শক্ত একটা কাগজে খানিকটা বিষের গুঁড়ো তুলে সে-গর্তে রাখল। আঙুলে টিপে টিপে গর্তের মুখ বুজিয়ে ফেলে কেকের টুকরোটা কাগজে মুড়ে নিল। কলঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে শক্ত কাগজটা প্যানের মধ্যে ফেলে সিস্টার্ন টেনে দিয়েছিল। সমস্যা হল দেশলাই বাক্সটা কোথায় লুকিয়ে রাখবে? শোবার ঘরে নয়, রান্নাঘরে তো নয়ই। ভেবেচিন্তে অবশেষে ঠিক করল, পাঞ্জাবির পকেটেই থাকুক, অফিসে তার ড্রয়ারে কাল রেখে দেবে। কেকের বাকি আধখানা, যাতে বিষ নেই, সেটা বাড়িতেই থাকুক পরে কাজে লাগতে পারে। তবে বিষাক্ত টুকরোটা পকেটে রাখল। এটাও সঙ্গে নিয়ে অফিসে যাবে, কাল বাড়ি ফেরার সময়, যদি ভগবান সদয় হন, শয়তানটাকে যদি তিনি এগিয়ে দেন কেকটা গেলাবার জন্য! সত্যেন উত্তেজনায় রাতে ঘুমোতে পারল না।
পরদিন অফিসে বেরোনোর মুহূর্ত থেকে তার স্নায়ুগুলো টানটান হয়ে উঠল। রক্ত চলাচলের বেগ বেড়ে উঠে শরীরটা ঝিমঝিম করতে লাগল। সারাদিন এই অবস্থায় একটা ঘোরের মধ্যে সে অফিসে কাটাল। কুকুরটার চেহারা, ভাবভঙ্গি অবিরত তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে মনে সে মহড়া দিল কীভাবে কেকটা ওকে দেবে। দূর থেকে ছুড়ে না কাছে এলে হাতে নিয়ে অপেক্ষা করবে? হাত থেকে খাওয়ানোটা কি নিরাপদ? যদি টের পেয়ে যায় তাকে মারার ষড়যন্ত্র হয়েছে, কেকে বিষ আছে, তাহলে কামড়ে দিলেও দিতে পারে। জানোয়ারদের অদ্ভুত একটা সিক্সথ সেন্স আছে। হঠাৎ আদিখ্যেতাকে ওরা সন্দেহ করবেই।
একটু দেরি করে ফেরার জন্য সত্যেন অফিস থেকে বেরিয়ে গঙ্গার দিকে গেল। অনেক দিন পর এই নদী দেখতে তার ভালো লাগল। কৈশোরে আহিরিটোলা ঘাটে সাঁতার কাটার, পাড়ার দুর্গা আর কালী পুজোর ভাসানের কথা তার মনে পড়ল। বাবুঘাটে অনেকক্ষণ বসে তার শরীর ও মন স্নিগ্ধ, ঢিলেঢালা হয়ে গেল। অবশেষে সে বাসে উঠল বাড়ি ফেরার জন্য।