লজ্জায় তোতলা স্বরে শিবু বলল, একটু একটু পারি।
নামো তাহলে। চার জন একসঙ্গে টানতে টানতে শিবুকে জলে ঠেলে দিল। অরুণ খুবই উৎসাহিত হল। চিত্রাকে ঘাটে পৌঁছে দিয়ে বলল, চলুন পারাপার করি।
না না পারব না আমি। প্রায় পঞ্চাশ মিটার লম্বা পুকুরের ওপারে তাকিয়ে শিবু বলল। সেই ছোটোবেলায় সাঁতার শিখেছিলাম, বছর দশেক হয়ে গেল। তারপর আর কাটিনি।
কিন্তু সকলের বারংবার অনুরোধে রাজি হয়ে গেল। অরুণ যখন ওপারে ছুঁয়ে এপারের ঘাটে এসে পৌঁছোল, শিবু তখনও ওপারেই পৌঁছোয়নি। শুরুতে মেয়েরা হইহই করে শিবুকে উৎসাহ দিচ্ছিল। পরে চিত্রা ছাড়া বাকি চার জন চুপ করে গেল এবং ক্রমশ তাদের মুখে কাঠিন্যের জটিলতা এল। সুপ্রিয়া বলল, ইচ্ছে করছে চুলের মুঠি ধরে ওটাকে চুবুনি দিই।
আমারও। দীপালি বলল। তারপরই একসঙ্গে ওরা চেঁচিয়ে উঠল, একী! ডুবে যাচ্ছে নাকি? মাঝপুকুরে শিবু ঘাটের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়ছে, হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। ঝাঁপিয়ে পড়ল অরুণ। শিবু ওকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই মুখে ঘুসি মেরে চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল ঘাটে। অবসন্ন হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে মাথা নামিয়ে শিবু বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। চিত্রা বলল, ও কি ডুবে যাচ্ছিল?
বোধ হয়। অরুণ কাঁধ ঝাঁকাল।
মাংস-ভাত ছাড়া আর কিছু রান্না হয়নি। ঝোলমাখা ভাত মুখে দিয়েই শিবুর দিকে তাকাল। থু থু করে ফেলে দিয়ে দীপালি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অরুণ উঠে গিয়ে তাকে ধরে আনল! নুন বেশি হয়ে গেছে হোক-না। দই মেখে সন্দেশ দিয়ে ভাত খান।
একটা-কিছুও যদি পারে! শীলা চেঁচিয়েই বলল—খালি বাহার দিয়ে মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করা।
শীলাকে চুপ করিয়ে দেবার জন্য অরুণ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, এমন আর কী নুন হয়েছে, আমার তো বেশ লাগছে। শিবনাথবাবু ওদের কথা একদম বিশ্বাস করবেন না। ওরা
খায় তো না খাক, আমরা বরং ভাগাভাগি করে সাবড়ে দিই! অরুণ ভাতের গ্রাস মুখে। দিল।
আমি একাই খেয়ে ফেলতে পারি সবটা। শিবু টেনে টেনে হাসতে শুরু করল।
থাক আর বাহাদুরি করতে হবে না। শীলা তাচ্ছিল্যভরে বলতেই শিবু মাংসের হাঁড়িটা নিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। কেউ ওকে ফিরিয়ে আনল না।
খাওয়ার পর দোতলার বারান্দায় পা ছড়িয়ে সবাই গল্প করছে। অরুণ আর চিত্রা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে, ভ্রুকুটি করছে, জিভ দেখিয়ে ভেংচি কাটছে, কিল দেখাচ্ছে আর মাঝে মাঝে গল্পে যোগ দিচ্ছে।
চারটি মেয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বলে থাকল। কিছু পরেই শিবু এল জ্বলজ্বলে চোখে।
ভেবেছিলে পারব না? সব শেষ করে দিয়েছি।
দু-কিলো মাংস খেয়ে ফেললে?
বাজে কথা। নিশ্চয় কোথাও ফেলে দিয়েছ কি কুকুরগুলোকে খাইয়ে দিয়ে বাহাদুরি ফলাচ্ছ।
মোটেই না। তোমরা চারদিক পরীক্ষা করে দেখতে পারো।
বসে থাকতে ভালো লাগছে না। একটা উপলক্ষ্য পেয়ে বাগানে বেরিয়ে চার জন চারিদিকে খুঁজতে শুরু করল। একসময় করুণা ছুটতে ছুটতে দীপালির কাছে এসে বলল, একটা ব্যাপার দেখবি আয়।
বাগানের একধারে একটা মাটির ঘর। সম্ভবত চেলাকাঠ, ঝুড়ি-কোদাল ইত্যাদি রাখার। দরজা বন্ধ। দীপালিকে টেনে এনে করুণা বলল, কান পেতে শোন।
সন্তর্পণে দীপালি দরজায় কান ঠেকিয়ে ফিরে এল পাংশু মুখে। অরুণ আর চিত্রা।
হ্যাঁ, ছাদে যাবার ভান করে এখানে!
আগে থাকতেই প্ল্যান করেছিল।
অন্য দুজনকে ডেকে ওরা খবরটা দিল। অবশেষে চার জনেই যখন ফিরে এল শিবু প্রবল উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, পেলে?
কী পাব?
যা খুঁজতে গিয়েছিলে?
ওরা কেউ জবাব দিল না। নিজেদের মধ্যে এলোমেলো কথা শুরু করল।
আজকের খবরের কাগজটা পড়ে আসা হয়নি।
বাবা বারণ করেছিল আসতে, জোর করে এসেছি।
আমার ঠিক উলটো, মা কোন ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে।
বড্ড খিদে পাচ্ছে।
পাবেই তো। ভাত না খেলে মনে হয় খাওয়াই হল না।
দ্যাখ-না কিছু যদি পাওয়া যায়। দেখেছিস কী সুন্দর ডাব হয়েছে।
পাড়বে কে, অরুণ তো উঠতে গিয়ে পারল না। আজ যদি ওদের মালীটা থাকত…
তার বাবাকে এই সময়েই বাঘে খেল।
আমি ডাব পাড়তে পারি। শিবু হঠাৎ বলে উঠল।
ওরা গ্রাহ্য করল না কথাটা। শিবু আবার বলল, যদি পাড়তে পারি তাহলে কী দেবে?
তা হলে? শীলা চোখ সরু করে বলল, আমাদের যাকে চাও ঘরে নিয়ে যেতে পারবে। আঙুল দিয়ে বাগানের মাটির ঘরটা দেখাল। শিবু কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে বলল, তাহলে আজ সকাল থেকে যা-যা ঘটেছে সব ভুলে যাবে বলো?
হ্যাঁ যাব। কিন্তু যদি না পাড়তে পার? দীপালি তেরিয়া হয়ে এগিয়ে গেল কয়েক পা।
একটু ভেবে শিবু বলল, তাহলে অন্য কলেজে ট্রান্সফার নোব।
না না, তোমাকে পারতেই হবে। এইটে অন্তত পারতেই হবে। করুণা অদ্ভুত গলায় বলল। শিবু অবাক হয়ে তাকিয়ে উত্তেজিত হিংস্র এবং কাতর চারটি মুখ থেকে কোনো অর্থ বার করতে পারল না।
খালি-গায়ে, পাজামাটা ঊরু পর্যন্ত গুটিয়ে, শিবু প্রায় চার তলা উঁচু একটা নারকেল গাছে
ওঠার চেষ্টা শুরু করল। ওরা গাছটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। কয়েক হাত উঠেই সে নেমে এল।
পেটে বড় চাপ লাগছে।
জানতুম এইরকম একটা অজুহাত দেবে। দীপালি স্থানত্যাগ করার ভঙ্গি করল।
শিবু কথা না বলে আবার ওঠার চেষ্টা শুরু করল। ধীরে ধীরে সে দোতলার উচ্চতা পার হল। চারটে মুখে বিস্ময় ফুটল। শিবু তিন-তলার কাছাকাছি পৌঁছোচ্ছে। একজন হাততালি দিয়ে উঠল। শিবু গাছটাকে জড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। দুটো পা পিছলে যাচ্ছে বার বার, আঙুলগুলো বেঁকিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইছে, পারছে না। একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে শীলা শাসানি দিল, শিবু খবরদার। এক ইঞ্চি নেমেছ কি ইট ছুড়ে মাথা ফাটিয়ে দোব। এই বলে সে ইট ছুড়ল। ঠক করে গাছে শব্দ হতেই ধড়ফড়িয়ে শিবু ওঠার চেষ্টা আরম্ভ করল। কয়েক হাত উঠে আবার সে জড়িয়ে রইল গাছটা। শরীর থরথর করে কাঁপছে, নিশ্বাস নিতে হাঁ করল, একটুখানি পিছলে নেমে এল!