ইণ্ডিয়ান সিগারেট নয়। খেয়েই দ্যাখো একটা। চিত্রা গম্ভীর স্বরে বলল।
এরপর সকলের অনুরোধে শিবু খেতে শুরু করল। অভ্যাস নেই, একটু পরেই কাশতে লাগল।
ও কী, ছেলেমানুষের মতো কাশছ কেন? আমি হলে তিন টানে শেষ করে দিতুম। শীলা ধমক দেবার ভঙ্গিতে বলল এবং হাত বাড়াল, দাও দেখিয়ে দিচ্ছি।
না না। শিবু সিগারেটটা সরাতে গিয়ে অরুণের স্টিয়ারিং ধরা হাতে ছ্যাঁকা দিল। অরুণ চমকে উঠতেই গাড়িটা বেটাল হয়ে ধাক্কা দিল পথের পাশে দাঁড়ানো একটা সাইকেলরিকশার চাকায়। চাকাটা দুমড়ে গেল।
হইহই করে কোথেকে ছুটে এল একদল লোক। গাড়ি ঘিরে তারা উত্তেজিত কথাবার্তা বলতে থাকল। চিত্রা ভয়ে আঁকড়ে ধরল অরুণের হাতটা। অন্য মেয়েরা শুকনো মুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া শিবুর দেহযন্ত্রের বাকি অংশ মৃতবৎ।
হয়েছে কী। অরুণ দরজা খুলে বেরোল। দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে সুন্দর স্বাস্থ্যটা জনতাকে দেখাল। কেউ তো মরেনি, তবে এত কথা কীসের? তার কতৃত্ববাচক কণ্ঠের দাপটে ওরা থ মেরে গেল। সারাতে কত লাগবে? পকেট থেকে জাঁদরেল একটা ওয়ালেট এবং তার মধ্য থেকে অনেকগুলো নোট বেরিয়ে আসতে দেখে নিভন্ত অগ্নিস্তুপ থেকে ফুলকির মতো কিছু ফিসফাস ছিটকে উঠল।
পঞ্চাশ টাকা লাগবে। ওদের মধ্য থেকে একজন বলল।
সারিয়ে নিতে পঞ্চাশ টাকা? – কুঁচকে অরুণ ধমকাল। কতগুলো নোট একজনের হাতে গুঁজে দিয়ে গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিতেই জনতা পথ ছেড়ে দিল।
মাইল খানেক যাবার পর চিত্রা প্রথম কথা বলল, ওরা গাড়িটা পুড়িয়ে দিত, না?
কী জানি। অরুণ শিস দেবার জন্য ঠোঁট সরু করে কী ভেবে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েদের দিকে তাকাল—সব চুপচাপ কেন। আরে ও কিছু নয়, নিন গান ধরুন। বলেই চেঁচিয়ে শুরু করল, আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত… শুধু চিত্রা ওর সঙ্গে যোগ দিল।
পিছনের সিটের চার জন মেয়ে কাঠের মতো বসে। হঠাৎ শিবু প্রাণপণে অরুণের সঙ্গে গলা মেলাতে লাগল। মিহি স্বরকে উধাও করতে গিয়ে স্বর ভেঙে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরে খানিক বাদে থেমে গেল।
থামলেন কেন, চলুক। আমরা ভাঙিগড়ি…
শিবু বাকি পথটা চিৎকার করতে করতে একা গান গেয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমেই দীপালি চাপা স্বরে শীলা, সুপ্রিয়া, করুণাকে বলল, ওটাকে না আনলেই হত।
কিছুক্ষণ পরেই ওরা রান্নার উদ্যোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মালী বারো মাইল দূরে তার গ্রামে গেছে। সকালে খবর এসেছে বাঘে তার বাবাকে মেরে আধ-খাওয়া দেহটা ফেলে রেখেছে। শুনেই সুপ্রিয়া বলল, বাঘটা যদি এখানে আসে?
কেন, শিবু রয়েছে; ভয় কী আমাদের? তিক্তস্বরে দীপালি বলল।
বাঘ কিন্তু মানুষ নয়, অরুণ হাসতে থাকল—টাকা দিয়ে পার পাওয়া যাবে না।
চিত্রা ছাড়া কেউ উচ্চস্বরে হাসল না। কলকাতা থেকে খাওয়ার সামগ্রী অরুণ এনেছে। শিবু উনুন ধরানোয় ব্যস্ত। কাজের ছুতোয় সে সকলের আড়ালে থাকতে চাইছে। অন্যরা কিছুক্ষণ বাগানে বেড়াল। বেল এবং কলা ছাড়া আর কিছু ফলেনি। কয়েকটা নারকেল গাছ রয়েছে। অরুণ জুতো-জামা খুলে একটা গাছে ওঠার চেষ্টা করল। হাত দশেক উঠে হাল ছেড়ে নেমে এসে বলল, বড় পিচ্ছল। তবে দিনদুপুরে তালিম নিলেই হয়ে যাবে।
করুণা ফিসফিস করে শীলার কানে বলল, সব কিছুতেই বাহাদুরির চেষ্টা, না?
শীলা ঘাড় নাড়ল। চিত্রা লক্ষ করেছে এই কানাকানি। কাছে এসে কারণ জানতে চাইল। শীলা বলল, করুণা বলছিল তোদের দুজনকে বেশ মানায়।
চিত্রা উথলে উঠে কী করবে ভেবে না পেয়ে বলল, শিবুটার এমন মেয়েলি স্বভাব, রান্না ছেড়ে কিছুতেই আসবে না। চল ওকে ধরে আনি।
করুণা আর শীলাকে টানতে টানতে চিত্রা নিয়ে চলল রান্নার দিকে। তখন সে বলল, তোদের ভাল লাগছে অরুণকে? খুব চঞ্চল ছটফটে, না রে?
সেইটাই তো ভালো, তবে কি শিবুর মতো হবে? শীলা বলল এবং করুণা ঘাড় নাড়ল।
ওর সঙ্গে কোনো তুলনাই চলে না। খুব ভালো হত যদি অরুণের মতো তোদেরও কেউ থাকত। চিত্রা সমবেদনা জানাল যেন। তাতে দুজনেই হাসবার চেষ্টা করল। তিন জনকে দেখে শিবু বলল, দ্যাখো তো নুন হয়েছে কি না। বাটিতে খানিকটা ঝোল এগিয়ে ধরল। চোখে মুখে উত্তেজনা। চিত্রা চুমুক দিয়ে জানাল নুন কম হয়েছে।
শিবু, আমরা একসঙ্গে রয়েছি, আর তুমি এভাবে আলাদা হয়ে থাকলে খুব খারাপ লাগবে। চলো।
বাঃ, খাওয়া-দাওয়া করতে হবে না বুঝি!
হবে। ওসব পরে করলেও চলবে, এখন তুমি বেরিয়ে এসো। শিবু কিছু আপত্তি করে অবশেষে নুন দিয়ে মাংসটা নামিয়েই যাচ্ছি বলে ওদের বিদায় করল।
পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে ওদের আর ভালো লাগল না। তখন অরুণ বলল, সাঁতার কাটা যাক। কেউ সাঁতার জানে না। কস্টিউম পরে অরুণ যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, ওর জানুদ্বয় ও নাভি এই নির্জন স্থানে মেয়েদের কাছে অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিজেদের মধ্যে আবোল-তাবোল কথা শুরু করল আর অন্যমনস্ক হবার ভান করতে লাগল। অরুণ একাই জলে কিছুক্ষণ ঝাঁপাঝাঁপি করে জলে নামার জন্য ওদের ডাকতে থাকল। অবশেষে চিত্রা নামল এবং তাকে পিঠে নিয়ে অরুণ সাঁতরাতে শুরু করল।
বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
রীতিমতো অসভ্যতা। এসব কী! আমরা রয়েছি খেয়াল নেই?
চার জন মেয়ে এইভাবে কথা বলতে থাকল এবং শিবু চুপ করে দেখছিল সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে। দীপালি বলল, সাঁতার জান না, তুমি যে কী-একটা।