শীলা বলল, টাকাপয়সার কথা বাদ দে। পিকনিক মানেই তো শুধু খাওয়া নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত সময়টাও কাটাতে হবে। সেইরকম কিছু তো আমরা নিয়ে যেতে পারি।
আমাদের একটা ট্রানজিস্টার আছে। করুণা উৎসাহভরে বলল।
অরুণদের তিন-চারটে আছে।
দীপালি তুই কী বলিস?
এরপর পাঁচ জন চুপ করে ভাবতে শুরু করল। চা খেতে খেতে শিবু ওদের দিকে তাকাচ্ছে। টেবিলে টোকা দিয়ে একটু গুনগুন করল। খাতাটা খুলে মনোেযোগে খানিকটা পড়ল। রাস্তা দিয়ে দুটি মেয়েকে যেতে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। তারপর ফুরুৎ ফুরুৎ শব্দ করে চা খেতে লাগল।
পেয়েছি! শীলা চাপাস্বরে বলল, শিবুটাকে নিয়ে চল, চমৎকার সময় কাটবে।
চার জনেই প্রথমে খুব অবাক হয়ে গেল শীলার কথায়। কিছুক্ষণ চাপা স্বরে তর্ক করল।
পাঁচটা মেয়ে আর একটা ছেলে পিকনিক করবে, কেমন যেন দেখায়। আর একটা ছেলেও চলুক-না।
পিকনিকে খাটাখাটুনিও তো আছে, করবে কে? ওকে বরং লাগিয়ে দেওয়া যাবে।
না না, অরুণদের মালী আছে, ওসব কাজ কাউকেই করতে হবে না। বরং ওকে জব্দ করব সারাদিন ধরে।
কথা এখন থাক বরং ওকে গিয়ে বল।
হঠাৎ পাঁচ জনকে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে শিবু হকচকিয়ে গেল। ওদের অনুরোধ শুনে তার সারা শরীরটাই দুলে উঠল।
না না, তোমরা যাচ্ছ, তার মধ্যে আমি কেন!
তাতে কী হয়েছে। চিত্রা বোঝাবার জন্য বলল, তুমিও তো আমাদের বন্ধু, আমরা ইনভাইট করছি। আমাদের সঙ্গে যাওয়া কি তুমি পছন্দ কর না?
না না, তাই বলেছি নাকি। তবে যার বাড়িতে যাব তারও তো মতামত নেওয়া দরকার।
চিত্রা বলল, তুমি আমাদের গেস্ট, তার নয়। আমরা যাকে খুশি নিয়ে যেতে পারি।
শিবনাথ, তাহলে না কোরো না। অরুণ তো আমাদের কাছেও প্রায় অপরিচিত। অবশ্য চিত্রার অসুবিধে হবে না, কিন্তু আমাদের চেনা একজন পুরুষমানুষ থাকলে স্বস্তি পাওয়া যাবে। ধরো ফট করে কারুর যদি কিছু হয়ে যায়… শীলা গম্ভীর হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল।
নিশ্চয় নিশ্চয়, শিবু জোরে ঘাড় নাড়ল। আজকাল কখন কী হয় কে বলতে পারে। ধরো
পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গেল।
তা কেন হবে! অরুণদের গাড়িটা নতুনই, গতবছর কেনা হয়েছে।
চিত্রা তুই থাম। শিবু ঠিকই বলেছে, ধর তেল ফুরিয়ে যায় যদি!
অতঃপর শিবুর যাওয়া ঠিক হয়ে গেল। পাঁচটি মেয়ে চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে হাসতে শুরু করল। তারপর যে যার বাড়ির দিকে রওনা হল।
দীপালির বাঁ-কানের উপর দগদগে পোড়া চিহ্ন। বারো বছর বয়সে অ্যাসিডের শিশি তাক থেকে পড়ে যায় ওর মাথায়। কানটা দোমড়ানো, চুলও ওঠেনি। একসঙ্গে কিছু যুবক সামনে দিয়ে আসছে দেখে সে মুখ ঘুরিয়ে ক্ষত লুকোবার চেষ্টা করল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে ওরা দ্বিতীয় বার আর তাকাল না। তবে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের মধ্যে একজন তাকে পিছন থেকে দেখল। দীপালি জানে, যে দেখল তার মুখ দিয়ে আক্ষেপসূচক ধ্বনি নির্গত হবে, দুই চোখে বিস্ময় ফুটবে। তার সুঠাম দেহ বহুক্ষণ ফিরে ফিরে দেখবে—ওই পর্যন্তই; দীপালি তা জানে। গভীর রাতে মাঝে মাঝে সে কাঁদে।
বাস স্টপে দাঁড়িয়ে শীলার ভাবনা হল, পিকনিকে যাওয়া তার হয়ে উঠবে কি না। আবার ভাই কিংবা বোন হবে। ক-দিন ধরে মা আর নড়াচড়া করতে পারছে না। অতবড়ো সংসার চালানোর ভার এখন তার ঘাড়ে। অবশ্য তেরো বছর বয়স থেকেই সে মা-র আঁতুড় তুলছে। কিন্তু এক দিনের জন্যও কি এখন বাড়ির বাইরে থাকা চলে? ভাবনায় পড়ল শীলা। তারপর মা-বাবা-ভাই–বোনদের উপর প্রচন্ড রাগে দপদপ করে উঠে বাসের অপেক্ষায় না থেকে হাঁটতে শুরু করল।
দ্রুত চলেছে সুপ্রিয়া, টিউশনিতে তার দেরি হয়ে গেছে। কুড়ি টাকার জন্য রোজ দুটো বিচ্ছুকে নিয়ে এক ঘণ্টা বসতে হয়। তার থেকেও সমস্যা ওদের মা-ঠাকুমাকে নিয়ে। রোজ শুনতে হচ্ছে তার মিষ্টিমুখ দেখে নাকি সংসারী হবার সাধ জেগেছে বাড়ির টাকমাথা হোঁতকা চেহারার প্রৌঢ় ছোটোছেলের। প্রায় ছ-শো টাকা মাইনে পায়। সুপ্রিয়া টের পাচ্ছে হয়তো একেই বিয়ে করতে হবে। কেননা ওরা শিগগিরই তার বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসবে এবং তা ফেরাবার সাধ্য চার মেয়ের স্কুলশিক্ষক বাবার নেই। চলতে চলতে সুপ্রিয়ার মনে হল, সামনের মোড়টা ঘুরলেই কেউ যদি তার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে দেয়। মোড় ঘুরে দেখল একটি সুদর্শন তরুণ তাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সুপ্রিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল।
করুণা একা দাঁড়িয়ে চৌমাথার মোড়ে। কাছেই বাড়ি। কিন্তু বাড়ি গিয়ে কী করবে? বউদি বলবে সিনেমা চলো, বাবা বলবে সেতার বাজিয়ে শোনা, মা বলবে একফোঁটা দুধ ফেলে রাখা চলবে না, মাস্টারমশাই বলবে ফাস্টক্লাস পাবার মতো মাথা আছে, বাবা বলবে ওকে ফরেন পাঠাব, বউদি বলবে রোজ স্কিপিং করো, মা বলবে সন্ধ্যে বেলায় শুয়ে থাকতে নেই, মাস্টারমশাই বলবে যেসব প্রশ্নের উত্তর লিখিয়ে দিয়েছি মুখস্ত করনি কেন, বউদি বলবে এখনও কেউ তোমাকে প্রেমপত্র দেয়নি তা কি হয়, বাবা বলবে পছন্দ করে যদি বিয়ে করিস আপত্তি করব না, মাস্টারমশাই বলবে আজকাল আর তুমি মন দিয়ে মোটেই পড়া শোন না।
করুণা একা দাঁড়িয়ে ভাবল, বাড়ি গিয়ে কী করব?
গাড়ি চালাতে চালাতে অরুণ বলল, নিন সিগারেট খান।
শিবু ঘাড় নাড়ল।
সে কী! আপনি তো অ্যাডাল্ট, প্রাপ্তবয়স্ক। বলে অরুণ ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েদের দিকে চেয়ে হাসল।
শিবু, লজ্জার কী আছে, আমরা কি তোমার মা-মাসি? করুণা আঙুল দিয়ে শিবুর কাঁধে খোঁচা দিল।