মন্মথ বলল, জানলাটা বন্ধ করে দাও নয়তো আস্তাকুঁড়ের গন্ধ আসবে।
থাক, রোজই তো খোলা থাকে।
আজ জঞ্জাল বেশি।
কণিকা শুধু চাউনিটা নামিয়ে আস্তাকুঁড়টা দেখল। আর দেখতে দেখতেই বলল, জঞ্জাল আর কোথায়, খাবারই তো।
একটু বুঝি হাওয়া দিল। শরীরটা ঠাণ্ডা লাগছে। মন্মথ চোখ খুলল। একভাবেই কণিকা জানলার দিকে তাকিয়ে। শান্ত, নিথর মন্মথর মনে পড়ল বাসনমাজা বউটিকে, তার শরীরের নড়াচড়াকে। মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে একটা ম্যাজম্যাজে অস্বস্তির চলাফেরা বোধ করল। উপুড় হয়ে দু-হাতে নিজের মাথা জড়িয়ে ধরল সে। সাবানের গন্ধ সরে গেছে শরীর থেকে, শরীরে এখন অস্বস্তি। কণিকার দিকে আড়ে তাকাল। শান্ত, নিথর। আবার একটু হাওয়া এল। হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্মথ টের পেল উৎসববাড়ির গন্ধ। বুঝে গেল কেন এখনও কণিকা জানলার দিকে মুখ করে জেগে আছে। কণিকার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন্মথ ভাবল, এইবার ওকে টেনে হিঁচড়ে বাইরের রকে নিয়ে গেলে কেমন হয়। ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই মন্মথ হাত বাড়াল আর চমকে হাতটা সরিয়ে নিল। মঞ্জু অঞ্জু কারোর গায়ে হাতটা পড়েছে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা শরীরের ম্যাজম্যাজে অস্বস্তিটা গুটিয়ে দলা পাকাল পাকস্থলীর মধ্যে। সারা শরীরটা গুলিয়ে উঠে প্রচন্ড খিদেয় আচ্ছন্ন হল। ক্রমশ সে ঝিমিয়ে পড়ল। ঘুম আসবার আগের মুহূর্তে সে দেখতে পেল পুঁটলি হাতে লোকটা ট্রামলাইন পেরিয়ে চলে যাচ্ছে।
একটি পিকনিকের অপমৃত্যু
কথায় কথায় চিত্রা বলেছিল, তার প্রেমিক অরুণ সাহাদের গ্রামের বাড়িটা বাগান-পুকুর সমেত বিশ বিঘের। ফাঁকাই পড়ে থাকে, কালেভদ্রে বাড়ির লোকেরা পিকনিক করতে যায়। তাই শুনে চিত্রার চার বন্ধু অর্থাৎ ইতিহাস অনার্সের শীলা, করুণা, দীপালি আর সুপ্রিয়া ওকে বলে, আমরাও একদিন গিয়ে পিকনিক করে আসব। কিছুদিন পরে চিত্রা ওদের জানাল, অরুণ রাজি হয়েছে। সামনের রোববার সে বাড়ির স্টেশনওয়াগানটাও পাচ্ছে, সবাইকে এক জায়গা থেকে তুলে নিয়ে যাবে। কলকাতা থেকে আঠারো মাইল দূরে ওদের গ্রামে যেতে বড়োজোড় আধঘণ্টা লাগবে। অরুণ খুব জোরে চালায়।
কলেজ ছুটির পর কাছের এক চায়ের দোকানে বসে ওরা কথা বলছিল। শীলা তার সরু গলাটা ঝুঁকিয়ে লিকলিকে হাত দুটো টেবিলে রেখে বলল, পারহেড কত করে দিতে হবে
সেটা এখনই ঠিক করে নেওয়া ভালো।
কাউকে কিছু দিতে হবে না, সব খরচ অরুণের। চিত্রা তাচ্ছিল্যভরে বলার খুব চেষ্টা করেও গর্ব লুকোতে পারল না।
না, তা কেন। দীপালি আপত্তি করল এক জনের ঘাড়ে সব খরচ চাপানো উচিত হবে না।
আমাদের পাঁচ জনের জন্য কটাকাই-বা খরচ হবে। ওদের ব্যাবসার পাবলিসিটিতেই তো বছরে যায় চল্লিশ হাজার টাকা। বলতে বলতে চিত্রা নিজেও অবাক হয়ে গেল।
তাহলেও আমাদের বাধো-বাধো ঠেকবেই। অরুণের সঙ্গে তোর ভাব, তোর খরচ নয় সে। দিল। কিন্তু আমাদের কেন দেবে?
তোরা আমার বন্ধু।
হলেই-বা। পিকনিকে সবাই সমান না হলে আনন্দ জমে না। এক জনই সব দিলে বাকিদের মনে হবে অনুগ্রহ নিচ্ছি, তাই না? দীপালি অন্যদের সমর্থন চাইল। শীলা ইতস্তত করল; সুপ্রিয়া ঘাড় নাড়ল। করুণা বলল, কিন্তু ভালো মনে যদি খরচের সব দায়িত্ব নেয়, তাহলে অবশ্য অনুগ্রহ নিচ্ছি বলে মনে হবে না।
হ্যাঁ হবে। দীপালি হঠাৎ গোঁয়ার হয়ে উঠল। অরুণের সঙ্গে যেদিন চিত্রা আলাপ করিয়ে দিল, মনে আছে তোর সেই চীনে রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই তুই কী বলেছিলি?
শীলা সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, কী বলেছিলুম?
এত খরচ করছে আর আমরা এক পয়সাও খরচ করতে পারছি না, কেমন লজ্জা লজ্জা করে। বলেছিলি কি না বল?
বড্ড বড়োলোক বাপু। শীলা আত্মসম্মান বজায় রেখে হাসবার চেষ্টা করল, ফসফস করে যেরকম পাঁচ-দশ টাকার নোট বার করছিল। পিকনিকে অবশ্য বড়োজোর পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিতে পারব, কিন্তু তাতে তো পেট্রোল খরচও উঠবে না।
ট্রেনে যাব। সুপ্রিয়া বলল।
এতই যখন তোমাদের মানসম্মানবোেধ, তাহলে বরং না যাওয়াই ভালো। চিত্রা উঠে দাঁড়াচ্ছিল, করুণা আর সুপ্রিয়া টেনে বসাল।
না না, আমার কাজ আছে।
রাগ দেখাতে হবে না আর। করুণা চিমটি কাটল চিত্রার হাতে। বাড়িতে তাহলে বলে দোব সব।
দে-না। সবাই জেনে গেছে।
এসব কথা এখন থাক। দীপালি বিরক্ত হয়ে বলল, আগে ঠিক কর যাওয়া হবে কি হবে। মোট কথা একদম কিছু কন্ট্রিবিউট না করে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
জানি, জানতুম, দীপালি একটা-না-একটা ফ্যাঁকড়া বার করবেই। অরুণের বাড়িতে যাচ্ছি, সে তো আতিথেয়তা করবেই। সুপ্রিয়া তোর বাড়িতে যদি যাই, বল তুই কি অ্যালাও করবি আমাদের পয়সা খরচ করতে দিতে?
সুপ্রিয়া ঘাড় নাড়ল মাদ্রাজি ঢঙে।
এই সময় একটি ছেলে ঢুকল চায়ের দোকানে। ওদের দেখে লাজুক হেসে দূরের একটা টেবিলে বসল। আদ্দির পাঞ্জাবি পরার জন্য জিরজিরে বুকের পকেটে এক টাকার নোট এবং কণ্ঠার হাড় স্পষ্ট। শ্যাম্পু করা চুল ফাঁপিয়ে এলোমেলো। রুমালে সুগন্ধি ঢালে। মেয়েদের ফাইফরমাশ পাওয়ার জন্য সতত ব্যস্ত। মুখটি কচি দেখায় দাড়ি না ওঠায়। কলেজের মেয়েরা হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে।
শিবুটা এখানেও! জ্বালালে। শীলা গম্ভীর হয়ে চেয়ারে হেলান দিলে বুকটা চিতিয়ে।
আঃ, আবার! করুণা কৃত্রিম ধমক দিল শীলাকে।
দেখুক-না, ওটা আবার পুরুষমানুষ নাকি।
ওসব কথা থাক। দীপালি বিরক্ত হয়ে বলল, কী আমরা দিতে পারি সেটা আগে ফয়সালা হোক।