ঘরেই শুক।
বাবা, তারপর?
তারপর তো মেজদাদু খেতে বসল।
যেখানে যত লোক ছিল সবাই ছুটে এল। মেজদিদিমা খালি বললেন, ওর শরীরটা ক-দিন ভালো যাচ্ছে না, একটু নজর রেখে পাতে দিয়ো।
থালার কানায় হাতের চেটো ঘষল মন্মথ, কাদার মতো ভাতের চাঁছি জমল। আঙুল দিয়ে সেটুকু মুখে পুরে সে উঠে পড়ল।
কিরণ ভাতে হাত দিয়ে গল্প শুনছিল, এইবার সে তাকাল কণিকার দিকে। খেয়াল হল কণিকার, অঞ্জু এতক্ষণ কিছুই খায়নি। বাকি ভাতটুকু একগ্রাসে ওর মুখে গুঁজে দিল।
কলঘরটা অন্ধকার। মেঝেয়-বসানো বালতিটায় ঠোক্কর লাগল। ঝন ঝন শব্দের মধ্যেই মঞ্জু বলল, মেজদাদু তোমার ডবল খেল?
হ্যাঁ খেল। পইপই বলি বালতি চৌবাচ্চার পাড়ে রাখবে। কে কথা শোনে!
মঞ্জু গা ঘেঁষে এল, কিরণের খাওয়া হয়ে গেছে। কণিকারও প্রায় শেষ। মন্মথর কথার পিঠে কেউ কথা বলল না, সেও চুপ করে রইল। বাইরে একটা লোক বোধ হয় কুকুর তাড়াচ্ছে। বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল মন্মথ। ঘরের মধ্যে ভীষণ গরম। রাস্তার হাওয়ায় শরীরটা জুড়োতে সে বেরিয়ে পড়ল।
দাঁ-দের রকটায় মন্মথ বসবার জায়গা পেল। পুঁটলি নিয়ে একটা লোক ওর সামনেই পথে বসল। লোকটা সন্দেশ আর লেডিকেনির দুটো স্থূপ আলাদা করে বেছে রেখে লুচি আর অন্য কীসব দিয়ে খাওয়া শেষ করল, মিষ্টি খেল না। গলা খাঁকিয়ে মন্মথ জিজ্ঞেস করল, ওগুলো খেলি না যে।
ওগুলো বেচব।
কোথায়?
মিষ্টির দোকানে।
লোকটা আর কথা বাড়াল না। হাঁটা শুরু করল। তাড়াতাড়ি মন্মথ ওর পিছু নিল। ও যেদিকে চলেছে সেদিকেই তো অমূল্যের দোকান। ট্রাম-রাস্তায় পৌছে মন্মথ হাঁপ ছাড়ল।
বন্ধ করবে কখন?
বন্ধের অনেক দেরি, সেই সাড়ে এগারোটা-বারোটা। খাটুনি কি কম, সেই সাড়ে পাঁচটা থেকে ভূতের মতো চরকিবাজি শুরু হয়েছে।
একটু অন্যমনস্কর মতো মন্মথ বলল, তোমার তো তবু ছোটো সংসার। চার-পাঁচটার মুখে অন্ন দিতে হয় না।
কথাটা বোধ হয় শুনতে পেল না অমূল্য। খদ্দের এসেছে। দই ওজন করা দেখল মন্মথ। ধারের খাতায় দাম টুকে রাখল অমূল্য। আবার খদ্দের এল, মন্মথ উঠে পড়ল। আর বসে থাকা যায় না, বসলেই বিড়ি খেতে হবে। ঘরে গিয়ে বসলে আঁস্তাকুড়ে ফেলা বিয়েবাড়ির খাবারের গন্ধ শুকতে হবে। গন্ধটা এমন যে গোগ্রাসে গেলার ইচ্ছে জাগে। অমূল্যর দোকান থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা যদি ধারে কেনা যায় কত আর পড়বে? পাঁচ-সাত টাকা। পাঁচ সিকে কি দেড় টাকায় প্রায় অতগুলো মিষ্টিই পাওয়া যেত।
হঠাৎ মন্মথর ভীষণ খিদে পেল। প্রায় পঁচিশটা মাছের টুকরো একসঙ্গে খেতে পারার মতো খিদে। ছ্যাঁৎ করে উঠল ওর বুক। একটা লোক পুঁটলি হাতে আসছে। অবিকল সেই লোকটার মতো। লোকটা চলে গেল পাশ দিয়ে, আর আশ্চর্য, খিদেটাও কমে গেল। বিয়েবাড়ির জলুস নিবু নিবু, হইচইটা হচ্ছে ফুলশয্যার অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে। এবার বর-বউ ঘরে ঢুকবে।
গন্ধ পেল মন্মথ। শব্দ না করে নিশ্বাস টেনে ফিসফিস করে বলল, সাবান মেখেছ বুঝি? আর একটু এগিয়ে এসে মন্মথর চিবুকে প্রায় গাল ঠেকাল কণিকা। হ্যাঁ, কিরণকে দিয়ে এক বালতি আনালুম। গা থেকে বড় টক টক গন্ধ বেরোয়।
দুজনে মাখলে তাড়াতাড়ি ফুরোবে।
আমি কি আর রোজ মাখছি।
সান্যাল বাড়িতে কিছু-একটা হল। অনেকে মিলে হেসে উঠছে। অনেক বাড়ির দেয়াল টপকে হাসিটা কণিকার নিশ্বাসের মতো দ্রুত চাপা হয়ে ঘরে পৌঁছোল।
অঞ্জু আজ কী বলছিল জান?
কী?
বলছিল মা আমাদের বাড়ি আর ভাত হবে না।
অত কাছে আসছ কেন, কিরণ ঘরে রয়েছে না?
মন্মথ কনুই দিয়ে ঠেলল কণিকাকে। কণিকা আরও সরে আসতে চাইল।
কী হচ্ছে কী?
চাপা ধমক দিল মন্মথ, শিথিল হয়ে গেল কণিকা। একটু সরে গেল, আর একটু বাদে কাত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। ওর পিঠে আলতো হাত রাখল মন্মথ। টিউব ওয়েলের বাসনমাজা বউটিকে মনে পড়ল। কণিকার পাঁজর চেপে মন্মথ টেনে আনল।
অঞ্জু কী বলছিল?
জানি না।
বলো না?
বললুম তো।
মন্মথর বুকে হাত বুলোতে শুরু করে কণিকা। হাতে ঠেকল গামাচি। নখ দিয়ে মেরে দিল। পুট করে উঠল।
বেশ শব্দটা, না?
হ্যাঁ।
মেরে দাও-না।
থাক এখন।
কণিকা হিঁচড়ে নিজেকে মন্মথর বুকের উপর তুলল। মন্মথর ঘাড়ে মুখ ঘষে বলল, সাবানের গন্ধটা বেশ না?
হ্যাঁ, কিন্তু কিরণ ঘরে রয়েছে।
ফিসফিস করে ঠিক একই সুরে কণিকা বলল, বাইরের রকে চলো-না।
রকে নর্দমার গন্ধ।
না, গন্ধ নেই। বিকেলে বাড়িউলি পরিষ্কার করেছে।
রাতে বাড়িউলি কলঘরে নামবে।
এখন নামবে না।
না না, না।
বিরক্তি ভয় আর উত্তেজনা মন্মথর কথাগুলোকে সারা ঘরে ছড়িয়ে দিল। আর ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল কিরণ।
কী হল তোর?
দরজা বন্ধ আছে?
হ্যাঁ আছে, তুই ঘুমো।
কিরণ শুয়ে পড়ল। নিঃশব্দে সাপের মতো শরীরটাকে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে কণিকা সরে গেল। আর একটু পরেই চটাস করে রঞ্জুর পিঠে চড় মেরে উঠে বসল কাঁথা বদলাবার জন্য।
মারলে কেন?
না মারবে না, খেটেখুটে একটু শোব তারও উপায় নেই, শত্তুর এসে জুটেছে।
আঃ, গাল দিচ্ছ কেন।
চুপ করে রইল কণিকা। মন্মথও। সারা ঘরে শুধু নিশ্বাস আর রঞ্জুর বিনিয়ে কান্নার শব্দ, তাও একটু পরে থেমে গেল। খলখল করে মজুমদার বাড়ির মেয়েরা ফিরল। দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে। চাকরটা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ওরা লুটোপুটি খেয়ে গল্প জুড়ল। খড়খড়ির পাখির ফুটো দিয়ে হান্টি কী যেন দেখছে।
কণিকা জলের মতো মেঝের উপর দিয়ে গড়িয়ে জানলার কাছে সরে এল। ওদের হাসির জন্য কিছু কিছু কথা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কনুই দুটো পিলসুজের মতো করে দু-হাতের চেটোয় সে মুখটাকে রাখল।