টিউকলে যাও-না।
কল টিপবে কে? কিরণ কোথা?
ও তো বেরিয়েছে, সেই খাওয়ায় সময় আসবে। ভালো কথা, ও শোবে কোথা? রকে তো আজ শুতে পারবে না।
শোবে আমার মাথায়।
ঝড়াৎ করে বালতিটা তুলে নিল মন্মথ। মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বলল, আয়। বলেই মন্মথ হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।
দাঁড়িয়ে আছিস যে?
যেন ঘুম ভাঙল মঞ্জুর। দরজা পর্যন্ত ছুটে গিয়েই ফিরে এল। লাল টুকটুকে রবারের চটিটা পরে সান্যাল বাড়ির সামনে দিয়ে গুটিগুটি করে ও টিউবওয়েলে পৌঁছোল। মন্মথ বালতি হাতে দাঁড়িয়ে। ওর আগে এসেছে মিষ্টির দোকানের অমূল্যচরণ। কলে বাসন মাজছে টিনের বাড়ির এক বউ। মন্মথকে দেখে বগল চুলকে অমূল্য হাসল।
এয়েচেন।
হুঁ।
ঠক করে বালতি রাখল মন্মথ। বউটি ঘাড় ফিরিয়ে দেখে আবার মাজতে লাগল।
একটু তাড়াতাড়ি করো গো। তারপর মন্মথবাবু খবর কী?
খবর আর কী, পাপের ভোগ বয়ে যাচ্ছি। চালের কন্ট্রোল তুলে কই দাম তত কমল না। আজ তো বারো আনা দে কিনলুম। দেশে চালের মন সাঁইত্রিশে, তাল খাচ্ছে মানুষে। তোমার আর কী; ছোটো সংসার, দোকানও চলছে ভালো, ছেলেপুলের ঝামেলা নেই।
ভালো আর চলছে কই।
কলে পাম্প করছে বউটি। অমূল্য অন্যমনস্ক হল আবার। মন্মথও দেখছে। কতভাবে কত বারই তো কণিকার পিঠ বগল সে দেখেছে। কই মনের মধ্যে তো এমনটি হয় না।
চাল তুমি কোথেকে কেন?
শ-বাজারে সুধীর সাহার দোকান থেকে। পাড়ার দোকান, ধারেও পাওয়া যায়।
আপনাদের এক সুবিধে, মাস গেলেই বাঁধা মাইনের টাকা। বাসেও টিকিট কাটতে হয় না। সুমুন্ধিটাকে কণ্ডাক্টর-মণ্ডাক্টর করে ঢুকিয়ে দিন-না। দু-বছর ফেল করে বসে আছে।
বউটি চলে গেল। কলে বালতি পাতল অমূল্য। মঞ্জু ওদের থেকে কিছুটা দূরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। বিয়েবাড়ির আলো ওর মুখে পড়েছে। আর একদফা খাওয়া শেষ হয়েছে। ভরপেট মানুষগুলো মঞ্জুর পাশ দিয়েই চলে গেল। সিগারেট ধরাতে দাঁড়িয়ে একজন তার সঙ্গীকে বলল, তুই একটা নেলা। গুচ্ছের পোলাও বসে বসে গিললি। মাছ খাবি তো।
ছ-টা মাছ খেয়েছি।
আমি শালা তেরোটা।
মন্মথর কানেও কথাগুলো গেছে। অমূল্য জল নিয়ে চলে গেল। মঞ্জু ডাক শুনেই দৌড়ে এল। ঘাড় নুইয়ে বাবু হয়ে মন্মথ বসেছে। হেঁচকি তোলার মতো হ্যাণ্ডেলটা তুলে বুক দিয়ে সাপটে মঞ্জু ঝুলে পড়ল। সরু ধারায় জল পড়ছে। মন্মথ মাথা চাপড়াল, পিঠ-বুক রগড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠল মঞ্জু।
সাবান ঘষতে শুরু করল মন্মথ। ডিপোয় গোলা সাবান দেয়। তাই দিয়ে তেল-কালি ওঠে কিন্তু ডিজেলের গন্ধ চামড়ায় বসে থাকে। গন্ধ সাবান মেখে সেই গন্ধ মারতে হয়। চুলে সাবান ঘষল মন্মথ। গাড়ির তলায় শুলে কি বনেটের মধ্যে মাথা ঢোকালেই চুলে কালি লাগবে। সেই কালি বালিশের ওয়াড় ময়লা করবে।
নেমন্তন্ন খেয়ে আরও কয়েক জন ফিরছে। টিউবওয়েলের কাছটা অন্ধকার। রাস্তার ধারে একজন পেচ্ছাব করতে বসল। সঙ্গীরা তার জন্য দাঁড়িয়ে রইল।
বউটা মাইরি বড় বোগা।
বিয়ের জল লেগে ঠিক হয়ে যাবে। আরে তুই কচ্ছিস কী? শেষকালে পাড়ার লোকদের যে আর একটা ডিভিসি তৈরি করতে হবে।
তাহলে তোকে চেয়ারম্যান করব।
এবার একটু মোটা হয়ে জল পড়ছে। মন্মথ খুশি হল। মাথা পেতে রাখল অনেকক্ষণ। মঞ্জু হাঁপাচ্ছে। ওকে কল টিপতে বারণ করে উঠে দাঁড়াল সে।
এবার বাড়ি চলে যা। দাঁড়া, সাবানটা নিয়ে যা। সাবান হাতে গুটিগুটি মঞ্জু ফিরে এল। সান্যাল বাড়ির সামনে সে একটুখানি দাঁড়িয়েছিল। হাত থেকে সাবানটা পড়ে গিয়েছিল। সাবানে-লাগা-ধুলো ফ্রকে ঘষতে ঘষতে সে দেখতে পেয়েছিল টিনাদি লাল-নীল কাগজ লোকেদের বিলোচ্ছে। ঠিক ওইরকম কাগজ দিয়েই মোড়া ছিল সাবানটা, যখন দোকান থেকে আসে।
রঞ্জু ঘুমিয়ে পড়েছে, অঞ্জর প্রায় সেই অবস্থা। কণিকা ওকে খাইয়ে দিচ্ছে। মন্মথর পাশে বসেছিল মঞ্জু। কিরণ ফিরবে ঠিক যখন কণিকা খেতে বসবে।
তুমি তেরোটা মাছ খেতে পার?
চান করে তাজা বোধ করছে মন্মথ। মঞ্জুর পাত থেকে ফেলে দেওয়া কাঁচালঙ্কাটা নিজের থালায় ঘষতে ঘষতে বলল, তারও বেশি পারি।
কণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে মন্মথ হাসল, কণিকাও। ব্যাপারটা মঞ্জুর চোখে পড়ল। বাবা-মার একসঙ্গে হাসি সে দেখেনি, আশকারা পেয়ে। বলল, যাঃ, মিথ্যে কথা।
গ্রাসটা মুখের কাছাকাছি একটু থামিয়ে গিলে ফেলল মন্মথ। অঞ্জু ঢুলে পড়ছে। বাঁ-হাতে ওর ঘাড়টাকে সিধে করে ধরে কণিকা ভাত গুজে দিল।
বিশ্বাস না হয় তোর মাকে জিজ্ঞেস কর। তোর এক মেজদাদু ছিল। মণিমাসিমার বাবা। ভীষণ খাইয়ে। এত্ত ভাত খেত আর গামলা গামলা মাংস। তোর ভাতের সময় নেমন্তন্ন খেয়ে যখন বাড়ি যাবে তখন বলেছিলুম, কাকাবাবু, আপনার আর আগের মতো খাওয়া নেই। শুনেই বললেন, তুমি যা খাবে, আমি এখুনি তার ডবল খেতে পারি। কেউ বিশ্বাস করে না তার কথা। কম করে অন্তত পঁচিশটা লেডিকেনি, এক হাঁড়ি দই আর পাঁচ-ছ গন্ডা মাছ খেয়েছে, এরপর আর কত খেতে পারবে। তাই দুম করে আমিও রাজি হয়ে গেলুম। বোধ হয় পনেরোটা মাছ খেয়েছিলুম, তাই না?
আ…হা পনেরোটা কোথায়? ছোটো বউদিই তো তোমার পাতে খান বারো দিয়েছিল, তারপর মেজকাকি এক খামচা।
কিরণ এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। মন্মথর সঙ্গে চোখাচোখি হল। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সে। ওর চাউনির বাইরে সরে যাবার চেষ্টা করতেই মন্মথ বলল, যাচ্ছিস কোথায়? খেয়ে নে।
তারপর কী হল বাবা?
ও আজ শোবে কোথায়?