হ্যাঁ, ওপারে দোকানে কাজ করে।
বুঝেছি, এই গলিটা দিয়েই ওর বাড়ি। কিন্তু ওকে কী দরকার আপনার?
সুধা বিরক্ত হল, তা দিয়ে তোমার কী দরকার! এই লোকগুলোর কৌতূহল বড়ো বেশিই হয়।
ওর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব।
বিড়িওয়ালা তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থাকল। সুধা বুঝল, সম্ভ্রান্ত কেউ যে এমন জায়গায় আসতে পারে তা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।
কিন্তু ওর বউ তো বেরিয়ে গেছে।
অ! কখন আসবে?
বেরিয়ে গেছে মানে বছর খানেক আগে এখানকারই এক ছোকরার সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
সুধা বিমূঢ় হয়ে বলল, মিস্ত্রির বউয়ের বয়স তো কমপক্ষে পঞ্চাশ হবেই।
কী যে বলেন! ওর তো দ্বিতীয় পক্ষের বউ। জোর পঁচিশ বয়স।
প্রথম বউ কি মারা গেছল?
হ্যাঁ, শুনেছি গলায় দড়ি দিয়ে।
ফিরে চলল সুধা। কাঠের ব্রিজে উঠেই দেখল হন্তদন্ত হয়ে হরিশংকর আসছে।
আমার বাড়িতে গেছলেন, কেন কী দরকার?
উত্তেজিত তো বটেই, চোখে ভয়ের ছাপও।
আপনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব। বাড়িটা ঠিক চিনতে পারছি না।
কী দরকার অ্যা, তার খুব অসুখ, দেখাটেখা হবে না। আর তার কাছে গিয়েও খুব সুবিধে হবে না বলে রাখছি। হরিশংকর রীতিমতো শাসাল।
কেন, সুবিধে হবে না কেন? আপনি ভেবেছেন আমায় খুব জাঁতাকলে ফেলেছেন, আর আমি বুঝি আপনাকে ফেলতে পারি না? থেমে গেল সুধা, কারণ একটা লোক ওদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। হরিশংকর বিস্ময়াহত! লোকটা কণ্ঠস্বরের পাল্লা ছাড়াতেই সুধা শুরু করল, আপনার বউকে গিয়ে বলব আপনি নাম ভাঁড়িয়ে আমায় বিয়ে করেছিলেন। অল্প বয়স ছিল, অতশত বুঝতে পারিনি। এখন এতদিন পরে সেই দাবিতে আপনি আমায় ফেরত চাইছেন।
সুধা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল, লোকটা নিশ্চয় বলবে, যান বলুন গিয়ে। আমার বউই নেই তো কাকে বলবেন।
খুবই আশ্বস্ত দেখাল হরিশংকরকে। মিথ্যে কথা, কেউ বিশ্বাসই করবে না। প্রমাণ আছে, অকাট্য প্রমাণ। আপনার কাছেই সেই বিয়ের সার্টিফিকেট রয়েছে। নিজের না হলে কেউ কি ওটা রেখে দেয়?
কিন্তু ওতে প্রফুল্লর নাম লেখা!
আপনি তো নাম ভাঁড়িয়েছিলেন, প্রমাণ করতে পারবেন আপনি নাম ভাঁড়াননি? আমি ছোটোকাকাকে সাক্ষী মানব।
ফ্যাকাশে হয়ে গেল হরিশংকর। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সুধা ভাবল, এইবার নিশ্চয় বুক চিতিয়ে বলবে, কাকে ভয় দেখাচ্ছেন? আমার বউ মরে গেছে, আবার বিয়ে করেছিলুম, সে-বউ পালিয়ে গেছে। কাকে বলবেন ওসব কথা?
কিন্তু ক্রমশ কুঁজো হয়ে গেল হরিশংকর। অবশেষে ব্রিজের রেলিং ধরে তাকে দাঁড়াতে হল। এসব কথা মিথ্যে হলেও ওকে বলবেন না, খুব আঘাত পাবে। বড়ো ভালোমানুষ। হয়তো গলায় দড়ি দিয়ে বসবে। আমার তো আর কেউ নেই ও ছাড়া।
সুধা আর কথা বলার দরকার বোধ করল না। বাড়ি ফেরার সময় খুব হালকা লাগল নিজেকে। মানুষ যে কতরকম মনের বাতিক পুষে রাখে আর তাইতেই কীভাবে আটকা পড়ে। সুখী হতে হলে এসব বাতিক থাকা উচিত নয়, সুধা মনে মনে পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোল। অতঃপর, পাখি হয়ে এখন আকাশে উড়তে পারি, এমন কথাও সে ভেবে ফেলল।