সুধা দু-চার বার কথা বলে জবাব না পেয়ে বাড়ি ফিরে এল রাগ নিয়ে। লোকটা কীভাবে বলতে পারল ওকে খুন করব ভাবছি! তাই কি সম্ভব?
বিছানায় শুয়ে অনেকরকম করে ভাবল তার পক্ষে হরিশংকরকে খুন করা আদৌ সম্ভব কি না। যেদিন পাখা লাগাতে আসবে এক কাপ চা দেব বিষ মিশিয়ে। গন্ধ পাবে না এমন বিষ। তবে বিষটা জোগাড় করতে হবে। ছোটোকাকার বন্ধুর এক ডাক্তার ছেলে আছে। ভালো ভালো বিষ নিশ্চয় তার কাছে থাকে। কিন্তু চাইলেই তো সন্দেহ করবে। আর হয় গলা টিপে মারা। তা পারা যাবে না, ওর গায়ের জোর বেশিই হবে। গঙ্গার ধারে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে যদি ঠেলে দেওয়া যায়? সাঁতার জানে কি না কে জানে! আর এক হয় দরজা খুলে পাশে দাঁড়াব। যেই ঢুকবে কয়লাভাঙা লোহাটা দিয়ে মাথায় কষাব। তিন-চার ঘা দিলেই মরবে। কিন্তু লাশ কীভাবে পাচার করা যায়?
সারা দুপুর সুধা ভাবল। রাতে এবং পরদিন দুপুরেও ভাবল। প্রায় বারো-তেরোটি উপায় পেল খুন করার। গুণ্ডা দিয়ে বোমা মারার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু কোনোটিই তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না বুঝে খুব বিমর্ষ হয়ে বিকেলেও বিছানা থেকে উঠল না। বন্ধুর মাকে বলল, শরীর খারাপ। শুনে বন্ধুর মা মুচকি হাসল।
সন্ধ্যার পর সুধীন বাড়ি ফিরল মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায়। জামায় রক্তের ছিট। দেখামাত্রই সুধা হাউমাউ করে উঠল, ও মা কে মারল, কী করেছিলে?
বাস থেকে পড়ে গেছি। সুধীন পাত্তা দিল না সুধার উদবেগকে।
কী করে পড়লে, নামতে গিয়ে না ওঠার সময়? যদি বাসের তলায় যেতে! বলেই সুধার মনে হল, তাহলে হরিশংকরের জারিজুরি আর চলত না।
ওই এক কথা। পড়ে গেলেই যেন বাসের তলায় যেতে হবে। কেন, গেলে কি তোমার সুবিধে হয়?
এই শুনে সুধা বিনিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বিরক্ত হয়ে সুধীন একটু পরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রাতে বিছানায় সুধা অভিযুক্ত করল সুধীনকে, তখন ওকথা বললে কেন! তুমি মরলে আমার কী সুবিধে হবে শুনি?
সুধীন নিরুত্তর রইল। নাড়া দিয়ে সুধা পুনরাবৃত্তি করতেই সুধীন উত্তেজিত হয়ে বলল, সব আগে ওই কথাটাই-বা তোমার মনে এল কেন যে আমি বাসের তলায় যেতুম! নিশ্চয় মনে মনে তাই ভাবছিলে।
শুনে সুধার মাথাটা গরম হতে শুরু করল। আমি কী ভাবছি তাই নিয়ে সকলেই ভাবছে দেখছি। কেন, এ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি তা কি হরিশংকর বা সুধীন মনে করে না? এতই কি আমি খারাপ।
আমার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?
কী আবার, কিছুই না।
ভালো-মন্দ কিছুই না?
না।
আমি মরে গেলে তোমার দুঃখ হবে না?
সুধীন মিনিট খানেক চুপ থেকে বলল, কী জানি।
সুধার মনে হল সুধীন সত্যি কথাই বলছে। তবে খুবই কম সময় নিল এত বড় একটা কথার জবাব দিতে।
তোমার কি মনে হয় আমাকে বিয়ে করে জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে? ভেবে উত্তর দাও। ভাবাভাবির আর কী আছে? সুধীন ক্লান্ত স্বরে বলল, যেমন বরাবর ছিলুম তেমনই আছি।
যদি বলি তোমাকে ভালোবাসি না, শুনে কষ্ট হবে না?
জবাব না দিয়ে সুধীন পাশ ফিরল।
যদি বলি, কোনোদিনই বাসিনি।
জবাব পেল না।
যদি বলি, অন্য একজনকে ভালোবাসতুম।
তাকেই বিয়ে করলে না কেন, তাহলে একটু ঘুমোতে পারতুম এখন। সুধীন পাশবালিশটাকে আরও জোরে আঁকড়ে ঘুমের মহড়া দিল। অপ্রতিভ হয়ে সুধা সরে এল নিজের জায়গায়। আজ দেরিতে চাঁদ উঠেছে। মেঝেয় অল্প একটু জ্যোৎস্না পড়ে। সুধার ইচ্ছা হল হাত বাড়াতে, বাড়িয়ে দিল। তারপর অনেক কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে যত বার মনে পড়ল রাতের কথাবার্তা, সুধার মন ভার হয়ে উঠল, অভিমান হল। ভালো করে কথা বলল না কারুর সঙ্গে। অবশ্য তার জন্য কেউই ব্যস্ত হল না, কারণও জিজ্ঞাসা করল না। শেষে সুধা ভাবল—কী দরকার ছিল এই বয়সে ওইসব কথা তোলার। দিব্যি তো চলে যাচ্ছে। তারপর মনে পড়ল, চলার উপায় নেই হরিশংকরের জন্য। অকাট্য প্রমাণ নিয়ে ও হাজির হয়েছে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুধা উপায় ভাবতে ভাবতে ঠিক করল একবার হরিশংকরের বাড়িতে যাবে। দরকার হলে কেঁদে ওর বউয়ের পা জড়িয়ে ধরবে। সিঁদুর পাঠিয়েছিল যখন, নিশ্চয় ভালো লোক। চাপ দিয়ে সার্টিফিকেটটা আদায় করিয়ে দেবে, মেয়েমানুষ হয়ে কি সে আর এক জনের বিপদে-সুধা সংশোধন করে ভাবল দুঃখ শব্দটা ব্যবহার করতে হবে, ওতে মনটা অনেক গলিয়ে দেয়। একটি মেয়ের দুঃখে বা একটি মায়ের দুঃখে কি আর এক মা পাশে এসে দাঁড়াবে না!
দুপুরে সে ইলেকট্রিকের দোকানে গেল। হরিশংকর জরুরি ডাক পেয়ে বেরিয়েছে, এখুনি আসবে। একটা অল্পবয়সি ছেলে দোকান আগলাচ্ছে। তার কাছ থেকে জানল হরিশংকরের বাড়ি কাছেই মিনিট পাঁচেকের পথ।
ঠিকানা এবং নির্দেশ নিয়ে সুধা রওনা হল। মিনিট দুয়েক পর পৌঁছোল খালধারে। এইবার ডান দিক। একটুখানি গিয়েই কাঠের ব্রিজ। এপারে এসে দু-ধারে শুধু কাঠের গোলা আর কাঁচা কাঠের চড়া গন্ধ। তাতে মাথা ঝিমঝিম করে, নেশার মতো লাগে। দুটো গোলার ফাঁকে একটা সরু রাস্তা আছে, তাই দিয়ে কিছুটা এগোলেই দোতলা মাঠকোঠা। কিন্তু সরু রাস্তাটাই সুধা বার করতে পারছে না। ওকে খোঁজাখুঁজি করতে দেখে অনেকেই তাকাচ্ছে, তাতে অস্বস্তি হতে লাগল। শেষে ঠিক করল একজনকে জিজ্ঞাসা করা যাক। জীবনের এত বড়ো একটা ব্যাপারে লজ্জা করলে চলে না।
ছুতোর শ্রেণির তিন জনকে সে জিজ্ঞাসা করল। কেউ বলতে পারল না, কারণ তারা এই অঞ্চলের লোক নয়। তখন ভাবল বিড়ির দোকানদার নিশ্চয় জানবে। মাঝবয়সি লোকটা বিড়ি বাঁধছিল দুলে দুলে। লুঙ্গিটা তাড়াতাড়ি হাঁটুর নীচে নামিয়ে বলল, কালো, রোগাপানা, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি তো!