সুধা দাঁড়িয়ে রইল আর পাখাটাকে মেরামত করার জন্য নিয়ে চলে গেল হরিশংকর। অন্যের বিয়ের অকাট্য প্রমাণটা আজও রেখে দিয়েছে! কেন? নিশ্চয়ই মতলব আছে। সুধার এই চিন্তায় সারা দুপুর-বিকেল তোলপাড় হয়ে গেল।
খুশি হল সুধীন। এই পাখাটায় হাওয়া যেন বেশিই লাগছে। চটপট সে ঘুমিয়ে পড়ল। সুধার ঘুম এল না। না আসারই কথা, কেননা বুকে পাষাণভার চেপে বসেছে। সার্টিফিকেটটা খুবই সর্বনেশে হয়ে উঠতে পারে। এই বয়সে যদি ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যায় তাহলে—সুধার মনে হল পাখাটা সুধীনের ঠিক পেটের উপর পড়বে। বেশ দুলছে মুন্ডু নাড়িয়ে। গর্তগুলো দিয়ে বিদ্যুৎ চিড়িক দিচ্ছে। যদি খুলে পড়ে! নির্ঘাত মৃত্যু ঘটবে। অ্যাকসিডেন্টই বলা হবে, কিন্তু হরিশংকরকে কি পুলিশে ধরবে না? যদি ধরে তাহলে বাঁচা যায়। তাহলে অবশ্য টেনে সংসার চালাতে হবে। একশো তিরিশ টাকা বাড়িভাড়া আর দেওয়া চলবে না। অফিস ইনশিওরেন্স মিলিয়ে হাজার পঞ্চাশেক, সেদিনই তো হিসেব করে সুধীন কত যেন বলল, পাওয়া যাবে। খোকার না দাঁড়ানো পর্যন্ত ওইতেই চলে যাবে। তা ছাড়া জমিটাও আছে। খোকার চাকরি হলে মেয়ে দেখতে হবে। ভালো মেয়ে পাওয়াও মুশকিল।
এই সময় বিড়বিড় করে সুধীন পাশ ফিরল। সুধা আন্দাজে হিসেব করে দেখল পাখাটা যদি পড়ে, ঠিক পেটে নয়, পিঠ ঘেঁষে পড়বে। তাতে মারাত্মক কিছু নাও ঘটতে পারে। এতে সে খুব আশ্বস্ত বোধ করল। গ্লানিও হল। সুধীন একটু রগচটা, খিটখিটে, কিন্তু মানুষ ভালো। এত বছর বিয়ে হলে কোন স্বামী-স্ত্রীর না ঝগড়াঝাঁটি হয়! সুধা হাত বাড়িয়ে সুধীনের পিঠে বোলাতে লাগল। একটা-দুটো ঘামাচিও মেরে দিল। এখন তার মায়া হচ্ছে।
দুপুরে দরজায় তালা দিয়ে সুধা বেরোল। বাস স্টপের কাছেই ইলেকট্রিকের দোকান। রাস্তা থেকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কাউন্টারের পিছনে বসে লাটাইয়ের মতো একটা জিনিসে হরিশংকর তার জড়াচ্ছিল। সুধা বলল, পাখাটা একটু তাড়াতাড়ি করে দিন।
বলেছি তত দিন পাঁচেক লাগবে। রুক্ষ স্বরে হরিশংকর বলল। হঠাৎ পিছন থেকে সুধার গলা শুনে চমকে উঠেছিল। সেই অপ্রতিভতার জন্যই যে রেগেছে সুধা তা বুঝতে পেরে, কাকুতি করে বলল, ইচ্ছে করলেই আপনি তাড়াতাড়ি পারেন। যেটা লাগিয়ে দিয়েছেন স্বরটা আদুরি করে— এমন বিচ্ছিরি দেখতে আর এমন দুলছে, বিদ্যুত চমকাচ্ছে যে ভয় হয় বুঝি খুলে পড়বে। উনি আবার ঠিক পাখার নীচেই শোন।
ওসব পাখা একটু দোলেই। হরিশংকরের নিস্পৃহ ভঙ্গি লক্ষ করে সুধা আহত হল। ভাবল, একটু পাষাণভার চাপিয়ে দিই।
ধরুন, যদি খুলেই পড়ে, তাহলে কাজে অবহেলার জন্য তো আপনাকেই পুলিশে ধরবে!
আমাকে? হরিশংকর ঘাড় বেঁকিয়ে তীব্র চোখে তাকাল। পুলিশ আমার কী করবে? তা ছাড়া… সিনেমার খল চরিত্রাভিনেতার মতো ঠোঁট মুচড়ে, চোখ সরু করে—পাখাটা যে আপনিই আলগা করে রাখেননি তার প্রমাণ কী?
যৎপরোনাস্তি চমকে উঠে সুধা বলল, কেন?
তাতে তো আপনারই লাভ।
কিছুক্ষণ দুজনে তাকিয়ে রইল।
প্রমাণ?
সার্টিফিকেট।
ওটা আপনার কাছে কেন? যার জিনিস তাকে ফেরত দেননি কেন?
সে তো মরে গেছে।
আমি তো বেঁচে আছি।
আপনি তো এখন আর প্রফুল্লর বউ নন।
হ্যাঁ, আমি ওর বউ, আমিই।
প্রমাণ?
সার্টিফিকেট।
ওটা কি আপনি ফেরত চান?
নিশ্চয়। আমার জিনিস আমি রাখব না? আপনি কেন রেখেছেন? নিশ্চয় কোনো মতলব আছে।
ওরা দুজন চাপা হিংস্রস্বরে কথা বলে যাচ্ছে যেহেতু দোকানটা রাস্তার উপর আর পথচারীরা কয়েক হাত দূরেই। হরিশংকর মুঠো-করা হাতটা কাউন্টারে আঘাত করে বলল, কী মতলব? যদি তাই-ই থাকত তাহলে ওটা ভাঙিয়ে আপনার কাছ থেকে টাকা কি আদায় করতে পারতাম না?
হরিশংকর অতঃপর অট্টহাসি করল না অর্থাৎ সে অভিনয় করছে না। সুধার ক্রোধ ভেস্তে গেল এই শুনে। এরকম হয় বলেই সে শুনেছে। যদি টাকা চেয়ে বসে, তাহলে? সোজা পা জড়িয়ে ধরব। নিশ্চয় দয়া হবে। বলব আমি অবুঝ, না ভেবেই বিয়েটা করেছিলাম। আসলে প্রফুল্লই ফুসলেছিল। খবরের কাগজে মামলার খবরে দেখেন-না?
তা ছাড়া আর যে-মতলব থাকতে পারে তা আপনার মতো থলথলে মুটকি আধবুড়িকে। দেখে মোটেই ইচ্ছে হয় না।
সুধা হাঁফ ছাড়ল। বয়স হওয়ার এই এক সুবিধা। কিন্তু সুধীনকে যদি প্রমাণটা দেখায়। এখনও তো অনেক দিন বাঁচব। সুধার মনে হল অনেক দিন বাঁচার লোভ আগে হয়নি, এখন হচ্ছে। ওই সার্টিফিকেটটা পেলেই আয়ু বেড়ে যাবে। কিন্তু পাওয়া যায় কী করে? হরিশংকর একদৃষ্টে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। কিছু-একটা গভীর হয়ে ভাবছে। সুধা গলাখাঁকারি দিল। হরিশংকর নিথরভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, আমি জানি আপনি এখন কী ভাবছেন। ভাবছেন লোকটা মরে গেলেই আপদ চোকে।
সে কী, মোটেই তা ভাবিনি। সুধা ক্ষুব্ধ তো বটেই, বিস্ময়ও বোধ করল।
ভাবছেন যদি না-মরে তাহলে খুন করব। এইরকমই মনে হয়। আপনি অস্বীকার করবেন করুন কিন্তু প্রফুল্লর জন্য আমাদের অনেকের সর্বনাশ হয়েছে, তাদের পরিবার ছারখার হয়েছে, এক-আধ জন তো নয়। ওই কাগজটা চাইছেন প্রফুল্লর বউ এই দাবিতে, তাই না?
না না, আমার স্বামী প্রফুল্ল নয়। এই দেখুন, আপনি খোকার বাবার কথাটা ভুলেই যাচ্ছেন। আসলে ওটা রেখে আপনার কী লাভ? দিয়ে দিলে একটি মেয়ের… শুধরে নিয়ে একই স্বরে একটি মায়ের যদি উপকার হয়, তাহলে দিয়ে দেওয়াই উচিত।
কথাগুলো হরিশংকর শুনল কি না কে জানে, তবে অন্যমনস্কর মতো বলল, আপনি এখন যান। পাখাটা সারানো হলেই দিয়ে আসব।