খোকাকে বলে দিয়ে মিস্ত্রিকে যেন বলে আসে পাখাটা নিয়ে যাবার জন্য। আর, একটা পাখা যেন ভাড়া করে আনে। এই বলে সুধীন বাসি খবরের কাগজ পড়তে শুরু করল। এই তো কত সহজেই ভাড়া করা যায়, সুধা ভাবল। মানুষ ভাড়া করা কি এর থেকেও শক্ত?
রাত্রে ঘুম এল না। সুধা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কাল পূর্ণিমা গেছে। খুব জ্যোৎস্না হয়েছে। হাতটা সে বাড়িয়ে দিল। বেলুড় থেকে নৌকোয় পার হওয়ার সময় এইরকম জ্যোৎস্না ছিল। হাতটা এগিয়ে ধরে প্রফুল্ল বলেছিল, ঠিক যেন বৃষ্টির মতো হাতে পড়ছে।
কিছুক্ষণ হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে সুধা টেনে নিল। বৃষ্টি না আর-কিছু, হলে তো বেঁচে যাই। তারপর ঘরে এসে গা আদুড় করে সুধীনের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন দুপুরে হরিশংকর একটা পুরোনো কালো পাখা নিয়ে এল। হাঁড়িটা মস্ত বড়ো। তাতে গোটা দশ-বারো গর্ত। সুধা মিষ্টি গলায় ওকে ভেতরে আসতে বলল। খুব ঘেমে গেছে দেখে আরও মিষ্টি করে বলল, এত ভারী একটা জিনিস বয়ে এনেছেন, আগে একটু জিরিয়ে নিন।
তাইতে নিরাসক্ত পেশাদারি গলায় হরিশংকর বলল, এসব অভ্যেস আছে। এবং তাইতে সুধার মনে হল, লোকটা সুবিধের নয়।
হরিশংকর পাশের ঘর থেকে চেয়ার আনল। টুলটা তার উপর রেখে কালো পাখাটা কাঁধে নিয়ে উঠতেই কালকের মতো সুধা আঁকড়ে রইল টুল।
আপনি খুব এক্সপার্ট, কতদিন এ কাজ করছেন? সুধা আলাপ জমাবার চেষ্টা শুরু করল।
অনেক দিন।
আগে তো কারখানায় কাজ করতেন।
হ্যাঁ।
তাহলে!
ঘাড় নীচু করে হরিশংকর তাকাল। গায়ে ব্লাউজ আছে, তবুও কেমন যেন করে উঠল। সুধার সর্বাঙ্গ।
আপনি জানেন না? হরিশংকর নিথর গলায় প্রশ্ন করল।
কী?
প্রফুল্লের জন্য আমরা ছাঁটাই হই।
না তো, কেন?
ব্লেডগুলোর দিকে আঙুল দেখাল হরিশংকর। সুধা এক-এক করে সেগুলো ওর হাতে তুলে দেবার সময় আবার বলল, কেন?
আমাদের স্ট্রাইকটা ভেঙে গেল ওর জন্যই। কোম্পানি ওকে ভালো চাকরি দিয়ে বদলি করে দেবে বলেছিল। ও টোপ গিলল। আমি, বলাই আরও দুজন ছাঁটাই হয়ে গেলুম। হরিশংকরের ভঙ্গি বা স্বরে রাগ নেই। কাজ করতে করতেই বলল, তখনকার দিনে এত কলকারখানা তো ছিল না। ভগ্নীপতির ইলেকট্রিকের দোকান ছিল, ঢুকলুম। তারপর নিজে এক মুসলমানের সঙ্গে দোকান করলুম। আড়াই বছর আগে যে দাঙ্গা হল তাতে দোকানটা লুঠ হয়ে গেল। সেই থেকে এই দোকানে কাজ করছি।
আর সেই ভদ্রলোক! সুধা বলতে যাচ্ছিল সেই সাক্ষী। শেষ মুহূর্তে ভদ্রলোক বেরিয়ে এল।
বলাই? সে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে।
অ্যাাঁ। সুধা বজ্রাহত হল পুলকে, মরে গেছে?
টুল থেকে নেমে এল হরিশংকর। সুইচ টিপল। পাখা ঘুরতে লাগল।
কে চাকরি দেবে বলুন। বড়ো সংসার ছিল। বহু চেষ্টা করেও কিছু পারল না। একদিন বলল, হরিদা, কারুর উপর আর আমার বিশ্বাস নেই। সবাইকে ঘেন্না করতে ইচ্ছে করে। আমি তবে বাঁচব কী করে? দু-দিন পর শুনলুম ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে।
সুধা ধীরে ধীরে খাটে বসল। তাহলে পাঁচ নয়, চার জনই রয়েছে। একটা দুশ্চিন্তার হাত থেকে রেহাই পেয়েই তার মনে হল বলাই লোকটা বোধ হয় সৎ। বিশ্বাস, ঘেন্না এসব নিয়ে মাথা ঘামানো কি আর বাজে লোকের কর্ম? এই লোকটা বাজে তাই গলায় দড়ি দেয়নি। দিলে চার নয়, তিন জন হয়ে যেত। মা-কাকা-কাকি। মা বুড়ি হয়েছে শিগগিরই মারা যাবে, তাহলে থাকবে দুই। ওরা দুজনই তো বিয়ের সম্বন্ধ করেছিল। সুতরাং জীবনে মুখ খুলবে না। কাজেই এক্ষেত্রে ওরাও মৃত। শুধু জ্যান্ত রয়েছে এই হরিশংকরটা।
প্রফুল্ল ছেলে খারাপ ছিল না। হরিশংকর সান্ত্বনা দিচ্ছে কি না সুধা বুঝে উঠতে পারল না। লোকটার হাবভাব এখন মোটেই মিস্ত্রির মতো নয়। এটা তার পছন্দ হচ্ছে না।
ওর পতন ঘটে আপনার সঙ্গে মেলামেশা হয়ে। অন্তত আমাদের তো তাই ধারণা। বিয়ে করে বউকে সুখে রাখবে, বোধ হয় সেইজন্যই…।
না না, আমি তো ওরকম কিছু চাইনি। আমি তো বলেছিলাম তুমি যেভাবে রাখবে সেইভাবেই থাকব। সুখে রাখবে এমন ছেলে কি তখন আমি পেতাম না? এই তো নিজের চোখেই এখন দেখুন-না। তবুও তো প্রফুল্লকে বিয়ে করেছিলাম। সুধা কিছুটা ব্যস্ত হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করল। লোকটা যেন তাকেই দায়ী করতে চাইছে। এটা খুবই অন্যায়। আসলে প্রফুল্লকে তো আর পাচ্ছে না তাই দোষটা এখন আমার ঘাড়ে চাপাতে চায়। সুধা দুঃখও বোধ করল। কতখানি ত্যাগ সে করেছিল, লোকটা তা নিয়ে একটা কথাও বলল না। সুধা রেগেও উঠল। কৃতকর্মের জন্য প্রফুল্লর নিশ্চয়ই অনুশোচনা হয়েছিল। নয়তো আত্মহত্যা করবে কেন? অথচ প্রফুল্লের এই মহৎ দিকটা একদমই দেখছে না লোকটা। দেখিয়ে দেওয়া উচিত বিবেচনায় সুধা বলল, কত অন্যায় কাজ করে কত লোক বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রফুল্লও তো আত্মহত্যা না করে থাকতে পারত!
আত্মহত্যা? অদ্ভুতভাবে হরিশংকর তাকাল ওর দিকে। স্বরে চিড় ধরিয়ে বলল, কে বলল আপনাকে?
কে আবার বলবে? শুধু প্রফুল্লরই পতন হয়েছিল আর আপনাদের কারুর হয়নি কতটা সত্যি যে অকাট্য কোনো প্রমাণ তো আর এখন পাওয়া যাবে না?
পাখাটা তাহলে নিয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ হরিশংকর আলোচনায় ছেদ টেনে পেশাদারি গলায় বলে উঠল, দিন পাঁচেক পরে পাবেন।
দরজার কাছে এসে আগের দিনের মতো ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার বিয়ের অকাট্য প্রমাণ ম্যারেজ সার্টিফিকেটটা কিন্তু আমার কাছে রয়ে গেছে। প্রফুল্ল আমার কাছে রেখেছিল আর ফেরত দেওয়া হয়নি।