সুধার একটু সময় লাগল মাথাটা ঘুরে উঠতে। ঝাপসা হয়ে গেল দেয়াল, সিঁড়ি এবং সামনের লোকটি। অস্ফুটে বলল, আপনি কার কথা বলছেন? আপনি কে?
আমার নাম হরিশংকর দাঁ। আপনার বিয়েতে আমি একজন সাক্ষী ছিলুম। এতদিন হয়ে গেল, আমাকে অবশ্য চিনতে না পারারই কথা। কতক্ষণই-বা দেখেছেন। আমি আর বলাই চন্দ সাক্ষী ছিলুম। আপনি ট্যাক্সি করে এলেন, চটপট সই করলুম আমরা। বাড়ি থেকে লুকিয়ে এসেছিলেন তাই তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিতেই চলে গেলেন। আমার বউ কাগজে মুড়ে সিঁদুর দিয়েছিল। মনে আছে, আপনার সিঁথিতে একটুখানি লাগিয়ে দিয়েছিলুম তাইতে আপনি খুব ভয় পেলেন!
সুধা একদৃষ্টে হরিশংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখে যে অবিশ্বাসটুকু ছিল তা ঘুচে গেছে।
কিন্তু এতদিন পর কীভাবে কোথা থেকে লোকটা হাজির হল! এটা যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়, তা ছাড়া আর কী, তাহলে ওর আসাটা ইচ্ছাকৃত নয়। সুতরাং ওর কোনো দোষ নেই। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী সুধীনের মুন্ডুর মতো পাখাটা। কেন যে খারাপ হয়, কোম্পানিটাই জোচ্চোর। কিন্তু কী আশ্চর্য, দড়াম করে সুধা দরজাটা বন্ধ করে দিল। এতদিন পর ও চিনতে পারল আর আমি পারলাম না! লোকটা তাহলে মনে করে রেখে দিয়েছে, তার মানে মতলব আছে।
অস্থির হয়ে খুব পায়চারি করল সুধা ঘর বারান্দা দালান ঘুরে। শেষে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। বুকটা ভার হয়ে আসছে। কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করল। খুলতেই সিলিং পাখার আংটা দেখল। জায়গাটা খালি খালি লাগল। তাইতে ওর মনে পড়ল এইরকম খালি কিংবা আর একটু বেশিই হবে, লেগেছিল প্রফুল্লর মৃত্যুর খবর পেয়ে। তার আগে অবশ্য বিয়ের ব্যাপারটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় দো-তলা থেকে এক-তলায় নামা বন্ধ হয়ে গেছল। খুব খুশি হয়েছিল বাড়ির সবাই। একে বেজাত, তায় চটকলের সামান্য কেরানি, ইউনিয়ন করে, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, মেসে থাকে, এমন ছেলের সঙ্গে বিয়েতে কে অখুশি না হয়! খোকা যদি মেয়ে হত, আর অমন একটা ছেলেকে যদি ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করে বসত! এই পৃথিবীতে, ব্যাপারটাকে বিরাট এবং জোরালো করার জন্য সুধা ভাবল—কোন বাপ-মা রাজি হবে? ধানবাদের কাছে জিটি রোডে প্রফুল্ল লরি চাপায় মারা গেল বিয়ের পনেরো কি যোলো দিন পরই। প্রফুল্ল ভেঁকুর তুলত, অম্বল ছিল। মাকুন্দও ছিল। বেশ কচি কচি একটা ভাব ছিল ওর মুখে। ছোটোকাকা বলল, যে গেছে তার জন্য দুঃখ করতে হয় কর, আমরা বুঝতেই পারছি। পাঁচ মাস ছ-মাস যত সময় চাস নে। কিন্তু কতবড়ো ভবিষ্যৎ তোর সামনে, বয়স তো মোটে বাইশ। একটা ভালো পাত্তর হাতে এসেছে, বিধবা হয়ে না থেকে বিয়ে করে ফ্যাল। আমরা চার জন ছাড়া কেউ জানতেও পারবে না। চার-জন মানে বাবা-মা কাকা-কাকি।
বাবা মারা গেছেন, তা হলে রইল তিন জন। হঠাৎ এই সাক্ষীটা এসে আবার চার জন হয়ে গেল। তাই-বা কী করে হয়? সুধা বিরক্ত হয়ে উঠল। বলাই চন্দ নামে একটা লোকের নাম করল, সেও তো জানে। তা হলে পাঁচ জন। কোনদিন দরজি কিংবা ছাতাসারাইওলা কিংবা বাস-কণ্ডাক্টর বলবে, আপনি মোটা হলেও, রংটা ময়লা হলেও গলার জড়লটা দেখে ঠিকই চিনেছি। আপনার বিয়েতে আমি সাক্ষী ছিলুম, চিনতে পারছেন না, আমি বলাই চন্দ। এই যে একটা চিহ্ন—শরীরের এত জায়গা থাকতে ভগবান কেন যে গলায় দেগে দিল!
সুধা গলায় হাত বুলোতে লাগল। জীবনের প্রথম চুমুটা এখানেই। প্রফুল্লই দিয়েছিল বেলুড়ে গঙ্গার ধারে বসে। এর কোনো সাক্ষীটাক্ষি নিশ্চয় হাজির হয়ে বলবে না আপনিও তো চুমু দিয়েছিলেন। বলা যায় না, কে ভেবেছিল এতদিন পর এই লোকটা হাজির হবে!
এটাও অ্যাকসিডেন্ট, অতএব সুধা একটু অসুবিধা বোধ করল—কাউকেই তো দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এই হরিশংকর যদি সুধীনকে বলে দেয়, মশাই আপনার বউয়ের আগে একটা বিয়ে হয়েছিল, তা জানেন কি? শোনামাত্রই রগচটা সুধীন হাতের কাছে যা পাবে দমাস করে কষিয়ে দেবে। যদি হরিশংকরকে কষায় তাহলে ও মরে যাবে।
সুধা মৃত হরিশঙ্করকে ভেবে ভয় পেল। এর জন্য সুধীনের নিশ্চয় ফাঁসি হবে। তবে সুধীন এমএ পাস, একটা ব্যাঙ্কের সাড়ে ন-শো টাকার দায়িত্ববান কর্মচারী। বি এসসি পড়া ছেলের বাবা, বউয়ের নামে সল্ট লেকে তিন কাঠা জমি কিনেছে, সে কি এমন হঠকারিতা করবে! নিশ্চয় প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যাবে। কাতর হয়ে পড়বে। একটা আঘাত তো বটে! শয্যাশায়ীও হতে পারে। সুধার মনে পড়ল, পাঁচ দিন কি চার দিন সে শুয়েছিল। চোখ দিয়ে খালি জল ঝরত। সুধীন যদি ওইভাবে কাঁদতে শুরু করে। আর একটা সম্ভাবনার কথাও ভাবা যায়। তখন মরতে ইচ্ছে করেছিল। এক্ষেত্রে সুধীনের এই খবরটা স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ তুল্যই। সুতরাং সে আত্মহত্যা করলেও করতে পারে। তবে যতদূর মনে হয়, সুধা আশা করল, তা করবে । তা হলে কী করতে পারে? অর্থাৎ এই কথাটা শোনার পর?
ভেবে ভেবে সুধা গোটা দুপুরটাই নাজেহাল হয়ে গেল।
শোনামাত্র সুধীন চিৎকার করে উঠল।
পাঁচ দিন গরমে পচতে হবে? আঠারো টাকা গচ্চা দিতে হবে যখন দিয়ে দিলেই পারতে। কালকে দেওয়া মানে দু-দিন গরমে পচা! সাধে কি আর বলি… পাশের ঘরে খোকা আছে তাই থেমে গেল।
লোকটা খাঁটি কি না না-জেনেই দিয়ে দোব? যদি ঠগ-জোচ্চোর হয়। এই বলেই সুধার মনে হল, সাক্ষী ছিলুম বললেই তো হয় না, প্রমাণ দিতে হবে। সুধীন যখন বলবে, মুখের কথায় এত বড়ো একটা ব্যাপার কি মেনে নেওয়া যায়। হরিশংকর তখন কীভাবে প্রমাণ করবে? সেই বলাই চন্দকে ডেকে আনবে? ওরকম সাক্ষী তো ভাড়া করেও আনা যায়। আসলে অকাট্য প্রমাণ চাই।