মনু তার ঘরে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে। মুকুন্দ দরজার কাছ থেকে বলল, তাজুকে পুলিশ নিয়ে গেল। বোধ হয় বেঁচে নেই।
লীলাবতী ও মিরা ছুটে এল বিবরণ শোনার জন্য। মুকুন্দ তখন কলঘরে ঢুকল। হঠাৎ পিছনে পায়ের শব্দে সে ঘাড় ঘোরাতেই দেখল মনু ঘর থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে কলঘরের দিকেই আসছে। কী হল! বলে মুকুন্দ দ্রুত গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। মনু তখন হড়হড় করে মুকুন্দর গায়ে বমি করল।
মধ্যরাত্রে মুকুন্দ নীচে নেমে এসে শিপ্রার ঘরের দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে যেতেই সে ঘরে ঢুকে শিপ্রাকে জড়িয়ে ধরল।
একী, একী! ঘরের মধ্যে নয়। ও রয়েছে যে!
থাকুক গে। শিপ্রাকে মেঝেতে শোয়াতে শোয়াতে মুকুন্দ বলল, ও তো মরে যাচ্ছেই, তাহলে আবার ভয় কীসের।
সুখীজীবন লাভের উপায়
ক-দিন খটাং খটাং করে অবশেষে পাখাটা মাঝরাতে বন্ধ হয়ে গেল। ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণটা বুঝে সুধীন খিঁচিয়ে উঠল, মনে করে একটা পাখা মিস্ত্রিও ডাকতে পারনি? সারারাত এখন ছটফট করি!
মিস্ত্রি কি আমি গিয়ে ডেকে আনব? পাঁচ দিন আগে বলেছি পাখাটা কীরকম বিদঘুটে শব্দ করছে, এক বার দ্যাখো। যতটা চাপা স্বরে নিঝুম রাতে ঝাঁঝ দেখানো যায়, সুধা দেখাল।
খোকাকে দিয়েও তো ডাকাতে পারতে, না সেটাও আমার জন্য তুলে রেখেছ! বিড়বিড় করতে করতে সুধীন মেঝেয় নেমে শুল। হুল ফুটিয়ে পাশের ঘরের টেবল পাখাটা বোলতার মতো শব্দ করে যাচ্ছে। ওটাকে নিয়ে এলে খোকার কষ্ট হবে এই ভেবে সুধা রান্নাঘর থেকে হাতপাখা এনে সুধীনকে বাতাস শুরু করল। বাইরে ফটফটে জ্যোৎস্না, সুধার মনে হল এর বদলে হু-হু হাওয়া দিলে দুর্ভোগ কত কমে যেত।
সকালে বাজার থেকে ফিরে সুধীন বলল, ইলেকট্রিক দোকানটা এখনও খোলেনি, কলেজ যাবার আগে খোকা যেন অবশ্যই মিস্ত্রিকে খবর দিয়ে আসে।
ওরা দুজন বেরিয়ে গেলে সুধার আর কিছু করার থাকে না। খাওয়া সেরে দিন রাতের ঝি বন্ধুর মা দুপুরটা মেয়ের বাড়ি কাটাতে যায়। সুধা দরজা-জানলা বন্ধ করে পাখা চালিয়ে মেঝেয় শুয়ে থাকে, আজ শুয়েছে খোকার ঘরে। ঘুমটা সবে জমে উঠছে, তখনই কড়া নাড়ার শব্দ হল।
দরজা খুলে দেখল শীর্ণদেহ আধবুড়ো একটা লোক, পরনে খাকি ট্রাউজার্স আর নীল হাওয়াই শার্ট—দুটোই ময়লা। কানের পিছন দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। জামায় ঘাম মুছে বলল, পাখা খারাপ হয়েছে বলে কি দোকানে খবর দিয়েছিলেন?
আমার ছেলে দিয়ে এসেছে, আসুন। মিস্ত্রিকে ঘরে নিয়ে এল সুধা। গায়ে ব্লাউজ না থাকায় খুব অস্বস্তি হচ্ছে, তবে লোকটা মিস্ত্রি আর ছেলেছোকরা নয়, সুতরাং আঁচলটা শুধু এপার-ওপার টেনে দিল।
মিস্ত্রি সুইচ টিপল, পাখা ঘুরল না। সেলাই কলের টুলটা টেনে নিয়ে বলল, একটা চেয়ারও লাগবে।
খোকার ঘর থেকে নিজেই চেয়ার আনবে কি না ভেবে সুধা ইতস্তত করল। এসব কাজ তো মিস্ত্রিদেরই করার কথা।
পাশের ঘরে আছে।
সুধা সঙ্গে করে মিস্ত্রিকে নিয়ে এল। খোকা কলমটলম ফেলে যায় টেবলে। চেয়ার এনে তার উপর টুলটা রাখল। রাখার জায়গা নেই বললেই হয়। একচুল সরে গেলেই টুলটা পড়ে যাবে। সুধা অবাক হয়ে গেল, অদ্ভুত কায়দায় মিস্ত্রিকে উপরে উঠতে দেখে। তাড়াতাড়ি সে টুলটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরল। মিস্ত্রি পাখার ব্লেড খুলতে খুলতে বলল, আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আপনি ছেড়ে দিন।
তবু যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যায়!
সুধার ভয় হল, তাহলেই তো পুলিশ টানাহ্যাঁচড়া করবে। অবশ্য অ্যাকসিডেন্ট মানেই অনিচ্ছাকৃত, তাতে দোষ নেই। মিস্ত্রি পাখার ব্লেডগুলো খোলে আর সুধা সেগুলো নিয়ে মেঝেয় রাখে, তারপর সিলিং-এর আংটা থেকে হাঁড়িটা চাড় দিয়ে তুলে খুলল। কাঁধে রাখল, সিধে অবস্থায় উবু হয়ে বসল, একটা পা সাবধানে টুলের নীচে চেয়ারে রাখল, তারপর অন্য পা। মেঝেয় নামল টুক করে লাফিয়ে। সুধা সারাক্ষণ টুল আঁকড়ে রইল।
পাখার হাঁড়িটা দেখে সুধার মনে হল—ব্লেডসমেত যখন ঘোরে তখন বোঝা যায় না, কিন্তু এখন দেখাচ্ছে ঠিক সুধীনের মুন্ডু। দুটো চোখ, একটু গোঁফ, টাক মাথা। শুধু যা টিকিটাই সুধীনের নেই। এটা ওরই কেনা, খোকা হবার দু-মাস পর। মিস্ত্রি স্ক্রগুলো খুলে মুভুর খুলিটা ফাঁক করল। বাসি রক্তের মতো চিটটিটে কালো তেল, ভুসি ইত্যাদি। সুধীনের মাথার মধ্যেটাও এরকম কি না-এই ধরনের একটা সন্দেহ সুধার মনে দেখা দেওয়ার উপক্রম করতে-না-করতেই মিস্ত্রি বলল, এখানে সারানো যাবে না, নিয়ে যেতে হবে।
কেন!
কম্যুটেটারের মাইকা গেছে। বলে মিস্ত্রি একটা জায়গা দেখাল, সুধার যেটাকে দাঁতের পাটি মনে হল।
ক-দিন লাগবে?
চার-পাঁচ দিন। মিস্ত্রি খুলিটাতে স্ক্রু আঁটতে আঁটতে বলল।
এই গরমে অ্যাদ্দিন পাখা ছাড়া। তাহলে তো মরেই যাব।
মিস্ত্রি হাসল, খুব গূঢ় ধরনের। শিশুরা আপন মনে যেভাবে হাসে বা শিশুদের হাসি দেখে
বয়স্করা।
হাতে এখন প্রচুর কাজ। পাঁচ দিনেও হয় কি না কে জানে।
কত লাগবে?
আঠারো টাকা।
বলল যেন হিসাব কষে, কিন্তু সুধার মনে হল, আগেই যেন ঠিক করে রেখেছিল। তবে পাখা হাতছাড়া করা চলবে না। লোকটা চোরছ্যাঁচড় কি না কে জানে। মিস্ত্রি সেজে এরকম তো অনেকেই আসে। তা ছাড়া আঠারো টাকার মতো ব্যাপার, সুধীনকে না জানিয়ে কী করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
উনি বরং আসুন, পরে জানাব। দু-দিক রেখে সুধা বলল।
পাখার মুন্ডুটা ঘরের একধারে সরিয়ে চেয়ারটা পাশের ঘরে রেখে মিস্ত্রি বেরিয়ে যাচ্ছে। সুধা সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে। দরজাটা পার হয়েই মিস্ত্রি হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনাকে প্রথমে চিনতেই পারিনি। বেশ মোটা হয়ে গেছেন। গলার জড়লটা দেখে চিনলাম আপনি প্রফুল্লর বউ।