ছটফট করে মুকুন্দ উঠে পড়ল। দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বার বার সে শিপ্রার দেহে, নানাবিধ অশ্লীল শব্দে এবং থ্রম্বোসিসে নিজেকে আবদ্ধ করে অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করল। কিন্তু সফল হল না। সব কিছু ছাপিয়ে মনুর কান্নাটা তাকে পেয়ে বসছে। ঘণ্টা খানেক পরে সে আবার থানার সামনে ফিরে এল এবং রকে বসতে গিয়েই দেখল মনু মাথা নীচু করে বেরিয়ে আসছে।
মনু। তীক্ষ্ণস্বরে মুকুন্দ ডাকল। মনু মুখ তুলে তাকাল। মুকুন্দ ছুটে গিয়ে প্রথমেই তন্নতন্ন করে ওর আপাদমস্তক দেখল। তারপর হেসে বলল, ছেড়ে দিল।
মাথা নেড়ে মনু ফিকে হাসল।
মারধর করেনি?
হাতটা মুচড়ে দিয়েছিল ধরার সময়।
ওর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে, হাঁটতে হাঁটতে মুকুন্দ বলল, অনেকক্ষণ খাসনি, আয় এই দোকানটায়।
আমার খিদে নেই।
ধরল কেন তোকে?
যে-ছেলেগুলোকে থানায় দেখলে, ওরা একটা স্কুলে ভাঙচুর করে বোমা ফাটিয়ে এসে আমার পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। হঠাৎ প্লেন-ড্রেস পুলিশ ঘিরে ধরে মারতে মারতে ওদের সঙ্গে আমাকেও ভ্যানে তুলল।
তুই যদি বুড়োমানুষ হতিস তাহলে ধরত না।
মনু জবাব দিল না। মিনিট খানেক পর মুকুন্দ বলল, অফিসে ফোন পেয়েই সোজা থানায় এসেছি। বাড়ির কেউ জানে না, তুই বাড়িতে এ সম্পর্কে কিছু বলিস না, তাহলেই তোর মা কান্না জুড়ে দেবে।
ঘাড় ফিরিয়ে মনু তাকাল ওর দিকে। চোখ দুটো দেখে মুকুন্দর বুকের মধ্যে ক্ষীণ একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। ধোঁয়ার কুন্ডলীর মধ্যে দিয়ে সে গৌরাঙ্গর চোখ দুটি দেখতে পেল। ঠিক এই চাহনিতেই সে চিত হয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়েছিল। মুকুন্দর আবার মনে হল, মনুর কেন ক্যানসার হবে!
তোকে আর কিছু কি জিজ্ঞাসা করেছে?
চমকে উঠে মনু ক্রু কুঁচকে অস্বাভাবিক স্বরে বলল, কী জিজ্ঞাসা করবে?
যা জানতে চাইছিল?
কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। মনু দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি এখন বাড়ি যাব না, তুমি কি বাড়ি যাবে?
আমি, মুকুন্দ দু-ধারে তাকিয়ে নিয়ে বলল, দেখি কোথাও গিয়ে সময় কাটাতে পারি কি না।
মনু ভিড়ে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত মুকুন্দ তাকিয়ে রইল। তারপর স্থির করল, ও ক্লাস নাইনে ওঠার পর আর মাতাল হইনি, আজ হব।
রাত প্রায় বারোটায় মুকুন্দ বাড়ি ফিরল। কড়া নাড়ার আগেই সদর দরজা খুলে গেল। অন্ধকারে শিপ্রাকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়াতেই চাপাস্বরে মনু বলল, এখন এত রাত করে বাড়ি ফিরো না।
মুকুন্দ অন্ধকারের মধ্যে মনুর মুখটা দুই করতলে এক বার চেপে ধরে কথা না বলে দোতলায় উঠে গেল।
সকালে দেরিতে ঘুম ভাঙল তার। চা খেতে খেতে মনুর খোঁজ করল। দুটি ছেলে তাকে ডেকে নিয়ে গেছে শুনেই চায়ের কাপ রেখে তাড়াতাড়ি মুকুন্দ রাস্তায় বেরিয়ে এসে মনুকে দেখতে পেল না। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল তার, শিপ্রাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, কারা ডাকতে এসেছিল?
এক জনকে দেখেছি, রোগাপানা, ফর্সা, মনুরই বয়সি।
হাতে কিছু ছিল?
কেন? ভীতস্বরে শিপ্রা বলল।
ধমকে উঠল মুকুন্দ, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও।
অতশত দেখিনি।
মুকুন্দ এবার ছুটে বেরোল। পরিচিতদের কাছে খোঁজ নিতে নিতে ট্রামরাস্তা পর্যন্ত পৌঁছোল। সেখান থেকে দু-তিনটে গলি ঘুরে গলাকাটা লাশটা যেখানে পড়েছিল সেখানে হাজির হল। এইসময় তার বুকফাটা কান্না পেল। বাড়ি ফিরতেই শিপ্রা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, মনু তো অনেকক্ষণ ফিরেছে।
একটা করে সিঁড়ি টপকে মুকুন্দ দোতলায় এল। মনু তার ঘরে চেয়ারে বসে জানলার বাইরে তাকিয়ে। মুকুন্দ ঘরে ঢুকেই বলল, কেন ওরা এসেছিল?
কারা। মনু স্থির চোখে মুকুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে চাহনিটা তুলে নিয়ে আবার জানলার বাইরে রাখল।
ওরা কি জেনেছে? ব্যগ্র স্বরে মুকুন্দ বলল।
কী জানবে? মনু এবার তীব্র চোখে তাকাল।
মুকুন্দ ফিসফিস করে বলল, আমি জানি রে, আমি জানি।
কী জান তুমি?
তোকে ভয় পেতে দেখেছিলুম।
কীসের ভয়?
শরীরটার জন্য ভয়।
তুমি পাও না? প্রশ্নটা করার জন্যই যেন নিজের উপর অভিমানে মনুর বসার ভঙ্গি কঠিন হয়ে গেল।
হ্যাঁ পাই। মুকুন্দ কোমল কণ্ঠে বলল, আমি তোকে দোষ দিচ্ছি না রে। যদি বলতে না চাস তো বলিস না। কিন্তু তুই আমার ছেলে, তোর জন্য আমি ভয় পাচ্ছি। সব বাবাই পায়। এটা কাপুরুষতা নয়।
তোমার ভয়টা ছেলের প্রাণের জন্য, তাই সেটা কাপুরুষতা নয়। মনু যান্ত্রিক স্বরে যেন মুখস্থ বলল।
এভাবে কথাটা নিচ্ছিস কেন! মুকুন্দ বিব্রত হয়ে বলল, আমাকে ঘেন্না করার নিশ্চয় অন্য কারণ আছে কিন্তু এজন্য করিসনি।
তুমি কি আমায় ঘেন্না করছ, আমি যা করেছি?
মোটেই না। আমি চিরকাল তোকে ভালোবাসব।
কিন্তু আমি নিজেকে ঘেন্না করছি। থানায় তুমি অমন করে আমার দিকে তাকালে, মনে হল আমি একটা মরামানুষ। কীরকম যেন ভয় করল আমার। নয়তো একটা কথাও বলতাম না, কিছুতেই না। মনু উঠে দাঁড়াল। টেবিলের বইগুলো অযথা ওলটপালট করতে করতে মমাচড়ানো স্বরে বলল, তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য। তুমি আমায় করাপ্ট করেছ।
মনু এক বার শুধু মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। মুকুন্দ তখন প্রত্যাশামতো নিশ্চিতরূপে দেখতে পেল, কঠিন বরফের মতো ঝকঝকে ওর চোখ দুটি। যেন শীতল ক্রোধে জমাট বেঁধে রয়েছে।
মুকুন্দর অফিসে যাবার সময় শিপ্রা দাঁড়িয়েছিল তার ঘরের দরজায়। সে হাসল। মুকুন্দ ক্ষেপ করল না। গলির মোড়ে লাল ডোরাকাটা জামা গায়ে তাজু দাঁড়িয়ে। মুকুন্দ তাকাল। বাস মাঝপথে বিকল হয়ে থেমে গেল। মুকুন্দ কণ্ডাক্টরের কাছ থেকে ভাড়ার পয়সা ফেরত নিল না। অফিসে অজিত ধরের প্রশ্নের উত্তরে জানাল, খবরটা ভুল। মনুকে ধরেনি। ছুটির পর ট্রাম থেকে নেমে মিনিট তিনেক হেঁটে বাড়ি। নামমাত্র দেখল জটলা করে লোকেরা ভীতচোখে তার পাড়ার দিকে তাকিয়ে বলাবলি করছে। একজন তাকে বলল, ওদিকে যাবেন না মশাই। এইমাত্র পর পর চারটে গুলির শব্দ হল। মুকুন্দ সেকথায় কান দিল না। একটা পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে। সেটাকে ঘুরে পার হয়েই সে থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপর মাথা নামিয়ে গলিতে ঢুকল। তার পাশ দিয়ে দুটো লোক পিস্তল রাইফেল পরিবৃত একটা লাল ডোরাকাটা নিথরদেহ বহন করে নিয়ে গেল। টপ টপ করে রক্ত ঝরছে। মুকুন্দ পিছন ফিরে তাকাল না। থমথমে গলির দু-পাশে ভীত, বিস্মিত এবং অব্যক্ত চাহনি ও মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সে বাড়িতে ঢুকল।