জানলায় শিপ্রা দাঁড়িয়েছিল। মুকুন্দকে দেখেই আলো জ্বেলে দরজা খুলে বলল, যা ভাবনা হচ্ছিল।
আমার জন্যে?
তবে না তো কী?
শুনে মুকুন্দর ভালো লাগল প্রথমে। তারপর ভাবল গৌরাঙ্গর জন্য একদম না ভাবাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তাই বলল, গৌরাঙ্গ আছে কেমন?
একইরকম। শিপ্রা সাধারণভাবে বলল এবং সহসা গলা নামিয়ে যোগ করল, মনু কেমন কেমন করে তাকাচ্ছিল। কাউকে বলে দেবে না তো? আমার কিন্তু বড় ভয় করছে।
বড়ো হয়েছে। মনে হয় না বলবে।
মুকুন্দ তাড়াতাড়ি উপরে উঠে গেল। ঘরের জানলাগুলো বন্ধ। মিরা ও লীলাবতী সিঁটিয়ে বসে রয়েছে। তাকে দেখে ওরা হাঁফ ছাড়ল।
মিরা বলল, জান কী কান্ড হয়েছে? একটা ছেলের গলা কেটে ফেলে রেখে গেছে খুদিরাম বসাক স্ট্রিটে!
মনু পাশের ঘর থেকে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, গোলমালের সময় অতুল বোস লেন দিয়ে না ঢুকে শেতলাতলার গলিটা দিয়ে আসাই সেফ।
ওর কথা শুনতে শুনতে মুকুন্দর মনে হল, মনু তাহলে এতক্ষণ উদবেগের মধ্যে ছিল। ছেলেটা আমার জন্য ভাবে, হয়তো বমি করবে না।
পরদিন অফিসে বেলা বারোটা নাগাদ মুকুন্দকে একজন টেলিফোনে উত্তেজিত স্বরে বলল, আপনার ছেলে মানবেন্দ্র সেনকে পুলিশ রাস্তা থেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।
কী বলছেন! মনুকে? মুকুন্দ চিৎকার করে উঠল। আপনি কী করে জানলেন?
আমার ভাইকেও ধরেছে। থানায় গেছলুম। আমাকে নাম আর ফোন নম্বর দিয়ে আপনার ছেলে জানিয়ে দিতে বলল। এখুনি থানায় গিয়ে চেষ্টা করুন ছাড়াতে পারেন কি না।
ফোন রেখে দেওয়ার শব্দ পেল মুকুন্দ। তারপরই ওর চোখ-কান দিয়ে হু-হু করে বাতাস ঢুকতে লাগল। কিছুক্ষণ সে কিছুই দেখতে পেল না, শুনতে পেল না। তারপর কাতর স্বরে অজিত ধরকে বলল, এইমাত্র একজন খবর দিল, ছেলেটাকে পুলিশে ধরেছে রাস্তা থেকে। কিন্তু মনু তো ওসব করে না, অত্যন্ত ভালো ছেলে। এখন কী করি বলো তো?
দেরি করবেন না, এখুনি থানায় গিয়ে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করুন। কেস লিখিয়ে ফেললে আর উপায় নেই, চালান করে দেবে। শুনেছি প্রচন্ড মার দিচ্ছে থানায়।
তোমার কেউ চেনাশোনো থানায় আছে? অন্তত যাকে বললে মারধর করবে না। মনুর ভীষণ দুর্বল শরীর।
অজিত ধর মাথা নাড়ল।
তুমি যাবে আমার সঙ্গে থানায়?
সাড়ে তিনশো লোকের স্যালারি স্টেটমেন্ট তৈরি করছি মুকুন্দদা, চার দিন পরই মাইনে। এখন তো ফেলে রেখে…।
মুকুন্দ পাঁচতলা থেকে নামল সিঁড়ি দিয়ে। ট্যাক্সিতে বার দুয়েক বলল, একটু জোরে চালান ভাই।
থানায় আট-দশটি ছেলের সঙ্গে মনুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওসি-কে বলল, আমার ছেলে কোনোকিছুর মধ্যে থাকে না স্যার, ওকে ভুল করে এনেছেন।
কোনটি আপনার ছেলে? গম্ভীর এবং যেন ক্লান্ত, এমন স্বরে ওসি বলল।
মুকুন্দ আঙুল তুলে দেখাবার সময় মনুর পাশে দাঁড়ানো হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটিকে কনুই তুলে খুব মন দিয়ে বাহুর থ্যাঁতলানো জায়গাটা পরীক্ষা করতে দেখল। মনুর দিকে তাকিয়ে ওসি বলল, সব বাপ-মা এসেই বলে, তাদের ছেলে নিরপরাধ। যদি নিরপরাধ হয়, তাহলে ছাড়া পাবে। আগে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখি।
কখন ছাড়বেন তাহলে?
ওসি কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, মনু হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে বলল, আমি কিছু করিনি। স্যার আমি কিছুই জানি না। বিশ্বাস করুন, আমি শুধু কলেজে যাচ্ছিলুম। খাতা ছাড়া হাতে আর কিছু ছিল না।
চুপ করো। কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে উঠল ওসি-র পাশে দাঁড়ানো ধুতিপরা লোকটি। থতোমতো হয়ে মনু তাকাল মুকুন্দর দিকে। দুটি ছেলে পাংশুমুখে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। লোকটি ধমকে আবার বলল, তাজু তোমার পাড়ার ছেলে আর তাকে তুমি চেন না?
মুকুন্দ ব্যস্ত হয়ে বলল, আমার ছেলে ওর সঙ্গে মেশে না স্যার।
বাজে কথা। আমাদের কাছে খবর আছে আপনার ছেলে ওর বন্ধু। তাজুকে কোথায় পাওয়া যাবে, দলে আর কে কে আছে বলুক, আপনার ছেলেকে ছেড়ে দোব।
মুকুন্দ দেখল মনু ঠকঠক করে কাঁপছে। ওকে এত ভয় পেতে দেখে সেও কাতর হয়ে পড়ল। চোখের জল মনুর ঠোঁটের কোল ঘুরে চোয়ালে পৌঁছে টলটল করছে। মুকুন্দের চোখ বাষ্পচ্ছন্ন হয়ে এল। আবছাভাবে গৌরাঙ্গর মুখটা ফুটে উঠল তার মনে। কাল সকালে এইরকম একটা বিন্দু টলটল করছিল ওর থুতনির কাছে। মেয়েটা তখন চুল ধরে টানছিল। কিন্তু মনুর তো ক্যানসার হয়নি! মুকুন্দ বিষগ্নচোখে তাকিয়ে রইল মনুর দিকে। শুধু কি শরীরের জন্যই ওর এই কান্না। রাস্তায় কাল বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়েছিল যে-ছেলেটি, সেও কি শরীটাকে ভালোবাসত না!
ওসি ঘরের একধারে গিয়ে লোকটির সঙ্গে চাপাস্বরে মিনিট দুয়েক কথা বলে ফিরে এল। আপনি এখন যান, সন্ধের দিকে এসে খোঁজ নেবেন।
বিশ্বাস করুন স্যার, আমার ছেলে জীবনে কখনো পলিটিকস করেনি। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন। মুকুন্দ ঝুঁকে ওসি-র হাঁটুতে হাত রাখল। হাতটা সরিয়ে দিতে দিতে ওসি বলল, আচ্ছা, ঘণ্টা দু-তিন পরেই আসুন, নিরাপরাধ হলে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেব।
বেরিয়ে এসে মুকুন্দ ঠিক করতে পারল না এবার কী করবে। থানার সামনেই একটা বাড়ির রকে বসে পড়ল। এখন অফিসে ফেরা আর এখানে বসে থাকা একই ব্যাপার। লীলাবতীর কান্নাকাটির থেকেও ভালো। বসে থাকতে থাকতে সে অবসন্ন বোধ করতে শুরু করল। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে তাকিয়ে রইল থানার ফটকে। ক্লান্ত মস্তিষ্কে এলোপাথাড়ি নানান বীভৎস দৃশ্য এখন সে দেখতে পাচ্ছে, অদ্ভুত করুণ শব্দ শুনতে পাচ্ছে। প্রত্যেকটাই স্নায়ুবিদারক।