ব্যাপার কী? এই বেশে তোমায় ঠিক মানাচ্ছে না ভাই, কেমন যেন বয়স্ক বয়স্ক লাগছে।
শিশিরকে মুহূর্তের জন্য অপ্রতিভ দেখাল। একটি সুঠাম মেয়ে শ্যামবাজারের বাসে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে ধাক্কা দিতে দিতে এগোল এবং হ্যাণ্ডেল ধরে পা রাখামাত্র বাস ছেড়ে দিল। পা-দানির একটি যুবক তৎক্ষণাৎ মেয়েটির পিঠে বাহুর বেড় দিল। শিশির বাসটার থেকে চোখ সরিয়ে তিক্তস্বরে বলল, এখন সব থেকে সেফ বুড়ো হয়ে যাওয়া। আমার পাশের বাড়ির ছেলেটাকে মাস খানেক আগে পুলিশ রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এমন মেরেছে যে হাঁটু দুটো এখনও ভালো করে মুড়তে পারে না। আমি জানি ছেলেটা কোনো গোলমালে নেই। শুধু ডাঁটো বয়সের জন্যই ওর সর্বনাশ হল।
মুকুন্দ চিন্তিত স্বরে বলল, আমার ছেলেও গোলমালে থাকে না, কিন্তু কার সঙ্গে মিশছে তা তো জানি না।
শিশির আলতো করে চুলে হাত বুলিয়ে বলল, আমার ভাই কাল বাড়িতে বোমা এনে লুকিয়ে রেখেছিল। জানেন মুকুন্দদা, আমরা খুব গরিব। খেলার জন্যই এই চাকরি। পঙ্গু হয়ে যাই যদি আমায় রাখবে কেন, এখনও তো কনফার্মড হইনি। এই শরীরটাই আমার সব।
মুকুন্দকে আর কিছু বলতে না দিয়ে শিশির প্রায় ছুটেই রাস্তা পার হয়ে ভিড়ে মিশে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুকুন্দও হাটতে শুরু করল। আধ ঘণ্টা হাঁটার পর তার মনে হল রাস্তা ক্রমশ ফাঁকা দেখাচ্ছে, পথচারী কম, গাড়িগুলি জোরে যাচ্ছে, সিআরপি-ভরতি লরি তিন-চার বার চোখে পড়ল, ক্ষীণ বিস্ফোরণের শব্দও শুনতে পেল। মুকুন্দ স্থির করল, গলি ধরে যাওয়াই ভালো।
মিনিট কয়েক পরেই মুকুন্দর গা-ছমছম করতে লাগল। যতই এগোয়, সব কিছু ভূতে পাওয়ার মতো ঠেকছে। বাড়িগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ। চাপা ফিসফাস শোনা যাচ্ছে। অন্ধকার ছাদে আবছা মুখের সারি। দূরে দূরে রাস্তার আলো, মাঝেরটা নেভা। দু-ধারের শ্যাওলাধরা, পলেস্তারা খসা, বিবর্ণ দেওয়ালগুলোর মাঝখানে গর্ত, ঢিপি আর আস্তাকুঁড়ভরা রাস্তাটাকে প্রাচীন সুড়ঙ্গের মতো দেখাচ্ছে। নিজের পায়ের শব্দে মুকুন্দর এবার মনে হতে লাগল কেউ পিছু নিয়েছে।
আর একটু এগিয়ে ডান দিকের গলিটা দিয়ে তিন-চার মিনিটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছানো যায়। তবু মুকুন্দ আর এগোতে সাহস পেল না। পাশের সরু গলির মধ্যে ঢুকে বড়োরাস্তার দিকে কিছুটা এগিয়ে আচমকা একটা রাইফেল ও দুটো পিস্তলের মুখোমুখি হয়ে দু-হাত তুলে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কোথায় যাচ্ছেন? সাদা প্যান্ট, হলুদ বুশশার্টপরা লোকটি মুকুন্দর পেটে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে রুক্ষস্বরে প্রশ্ন করল।
বাড়ি যাচ্ছি স্যার, পাশের বন্ধু সরকার লেনে থাকি।
তাহলে এখানে কেন?
অফিস থেকে ফিরছি। গোলমাল দেখে গলি দিয়ে যাচ্ছিলুম।
পাড়ায় কারা কারা বোমা ছোড়ে?
জানি না স্যার।
না কি বলবেন না?
ইউনিফর্মপরা ভারিক্কি ধরনের যে-লোকটি এতক্ষণ শুধুই মুকুন্দর দিকে তাকিয়েছিল, বলল, নিয়ে গিয়ে দেখাও তো, আইডেন্টিফাই করতে পারে কি না।
মুকুন্দর কোমরে পিস্তলের খোঁচা দিয়ে হলুদ বুশশার্ট বলল, বাঁয়ে।
সে তখুনি বাঁ-দিকে ফিরে, দু-হাত তুলে চলতে শুরু করল। রাস্তার যেখানটায় আলো কম এবং দুটো বাড়ির দেওয়াল দ-এর মতো হয়ে একটা কোণ তৈরি করেছে সেখানে টর্চের আলো ফেলে লোকটি বলল, ওকে চেনেন?
মুকুন্দ দেখল, একটা দেহ উপুড় হয়ে পড়ে, মুখটা পাশে ফেরানো। দু-হাত তোলা অবস্থায় এগিয়ে এসে ঝুঁকে মনু বলে অস্ফুটে কাতরে উঠেই বুঝল, দেখতে অনেকটা মনুর মতোই। চোখের পাতা খোলা, নীল জামাটা ফালা হয়ে পিঠ উন্মুক্ত, কঠিনভাবে আঙুলগুলো মুঠোকরা, ঠোঁট দুটো চেপে রয়েছে, গলায় গভীর ক্ষত। হিঁচড়ে টেনে আনার দাগ প্যান্টে। গলা থেকে চোয়ানো রক্ত থকথকে হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
এর নাম মনু?
না না, আমার ছেলের নাম মনু। একে অনেকটা তার মতো দেখতে। একে আমি একদম চিনি না স্যার।
কখনো একে দেখেননি? ভালো করে দেখে বলুন।
মুকুন্দ আবার ঝুঁকে পড়ল। গোড়ালি থেকে মাথার প্রান্ত জমাটবাঁধা আগ্নেয়গিরি লাভার একটা ঢেউ-খেলানো খন্ডের মতো। এই খন্ডটাই উত্তপ্তকালে ওর সর্বস্ব ছিল। ওর যন্ত্রণা, বিস্ময় আর দাপট। এখন ভোলা চোখ দুটি থেকে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নির্গত হচ্ছে না।
মাথা নেড়ে মুকুন্দ বলল, না, একে কখনো দেখিনি।
আচ্ছা চলে যান, এধার-ওধার করবেন না।
কিছুদূর গিয়ে মুকুন্দ ফিরে তাকাল। বুশশার্ট তাকে লক্ষ করছে। লাশটা এখন অন্ধকারে। মুকুন্দ মনে মনে বলল, আর একটা আনআইডেন্টিফায়েড ডেডবডি। তারপর বুকপকেটে হাত দিয়ে স্বস্তি বোধ করল। এবার গলিটা আর একটা গলিকে কেটে সোজা মুকুন্দর পাড়ায় ঢুকে গেছে। মোড়টা আধো অন্ধকার। দুটি ছেলে হঠাৎ দেওয়াল কুঁড়েই যেন তার সামনে এসে দাঁড়াল। একজনের হাতে ফুট দুয়েক লম্বা ঝকঝকে ইস্পাত।
কী জিজ্ঞাসা করছিল?
মুকুন্দ চিনতে পারল ছেলেটিকে। মনুর বন্ধু ছিল ছোটোবেলায়। তখন বাড়িতে আসত, নাম তাজু। না-থেমে গঙ্গা পারাপার করে বলে শুনেছে। এখন পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানেই প্রায়-সময় কাটায়। মনু এখন ওর সঙ্গে মেশে না।
কিছুই না। শুধু জানতে চাইল লাশটাকে চিনি কি না।
আমাদের কারুর কথা জিজ্ঞেস করল?
না।
খবরদার, বলবেন না কিছু।
ওরা দুজনে আবার দেওয়ালে সেঁধিয়ে গেল। দুটি স্ত্রীলোককে নিয়ে একটি রিকশা আসছে। একজনকে বিরক্ত স্বরে মুকুন্দ বলতে শুনল–ওম্মা, এইতো যাবার সময় দেখে গেলুম সব ঠাণ্ডা।