শিপ্রা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। মনু মাথা নীচু করে মুকুন্দর পাশ দিয়েই উপরে উঠে গেল। সদর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মুকুন্দ অসহায় বোধ করে অবশেষে শিপ্রার ঘরের জানলায় তাকাল। গৌরাঙ্গর চুল ধরে বাচ্চামেয়েটি টানাটানি করছে। গৌরাঙ্গর চোখ থেকে জল গড়িয়ে ঠোঁটের কোল ঘুরে চোয়ালে পৌঁছে টলটলে একটা বিন্দু হয়ে রয়েছে।
বাসে প্রচন্ড চাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মুকুন্দর মনে পড়ল, জয়ার শ্বশুর বাসের মধ্যে থ্রম্বোসিসে মরে গেছল। তারপর মনে হল, মনু কি আমায় ঘেন্না করবে?
আজ সকালে আমাদের পাড়ার মধ্যে একটা খুন হয়েছে। মুকুন্দর পিছনে কে একজন কাকে বলল, পাইপগান দিয়ে মেরেছে। বছর আঠারো বয়স হবে।
রাস্তাতেই?
তবে না তো কোথায়? বাড়ি থেকে বার করে রাস্তা-ভরতি লোকের সামনেই।
কেউ কিছু করল না?
পাগল! করতে গিয়ে কে প্রাণ খোয়াবে?
পুলিশ?
এসে বডিটা নিয়ে গেল।
অ্যারেস্ট করেনি তো কাউকে? যা পেটান পেটাচ্ছে তাতে নাকি চিরজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে?
বাসের লোকেরা এরপর পেটানোর নানান বীভৎস পদ্ধতির আলোচনা শুরু করল। মুকুন্দ তখন ভাবতে লাগল, আরও পনেরো-কুড়ি বছর যদি বাঁচি, তাহলে মনুকে নিয়েই তো বাঁচতে হবে। কিন্তু কী করে বাঁচব যদি ও ঘেন্না করে?
অফিসের লিফটে পাঁচ তলায় ওঠার সময় সে ভাবতে লাগল, মনু কি ওর মাকে ব্যাপারটা বলে দেবে? একেবারে ছেলেমানুষ নয়, সিরিয়াস ধরনের। হয়তো লজ্জায় নাও বলতে পারে। এই সময় মুকুন্দ শুনল, তার সামনের লোকটি পাশের জনকে বলছে, না ভাই, শরীর খারাপ নয়। ভাগনাটা পরশু মার্ডার হয়েছে, এখনও লাশ পাওয়া যাচ্ছে না। মনটা তাই.. লিফট চার-তলায় থামতেই ওরা দুজন বেরিয়ে গেল।
চেয়ারে বসামাত্র পাশের টেবিলের অজিত ধর মাথা হেলিয়ে বলল, মুকুন্দদা আজকের কাগজ দেখেছেন? চার-চারটে থ্রম্বোসিস ডেথ ফ্রন্ট পেজেই। সবাই অ্যাবাভ ফিফটি।
আমার ফিফটি ওয়ান। মুকুন্দ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল টেবিলের ফাটল থেকে উঠে আসা ছারপোকাটার দিকে, এবং সেটা একটা ফাইলের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবার পর আবার বলল, আমার একান্ন শুরু হয়েছে।
এবার সাবধান হোন। স্নেহ-জাতীয় জিনিস খাওয়া কমান আর লাইট ধরনের কিছু ব্যায়াম
করুন।
অজিত ধরের স্বাস্থ্যটি চমৎকার। বছর পনেরো আগে ওয়েটলিফটিং-এ স্টেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ফেদারওয়েটে। বিয়ে করেনি। এখন তবলা শিখছে। মুকুন্দ ড্রয়ার থেকে দোয়াত বার করে কলমের ক্যাপ খুলতে খুলতে বলল, তোমার এসব হবে না।
কী করে জানলেন?
যারা হ্যাপি যাদের উদবেগ নেই তাদের হয় না। থ্রম্বোসিসে ক-টা মেয়েমানুষ মরেছে?
কিন্তু আমি মেয়েমানুষ নই। অজিত ধর গম্ভীর হয়ে মুখ ফেরাল। মুকুন্দর মনে পড়ল জয়ার শ্বশুরকে পাঁচ দিন পর মর্গে পাওয়া যায়, পচ ধরে বীভৎস দেখাচ্ছিল, মুখে রুমাল চাপা দিয়ে বেরিয়ে এসেই জয়ার ভাশুর বমি করে ফেলে। আইডেন্টিফাই করার মতো কোনোকিছু সঙ্গে থাকলে ভদ্রলোক তার ছেলেকে বমি করাত না।
এবার মুকুন্দ কৌতূহলবশতই ভাবল, বাসে আজ যদি থ্রম্বোসিসে মারা যেতাম, তাহলে আমার লাশটার কী হত? বাসটা নিশ্চয় থেমে যাবে। কেউ বলবে হাসপাতালে, কেউ বলবে থানায় বাসটাকে নিয়ে চলো। তার মধ্যে সেই লোকটা যে বলেছিল, পাগল! করতে গিয়ে কে প্রাণ খোয়াবে? বলবে একদমই যখন মরে গেছে তখন আমাদের অফিস লেট করিয়ে লাভ কী, বরং এখানেই নামিয়ে দিন, পাবলিক কিংবা পুলিশ ব্যবস্থা করে দেবে। শুনে মনে মনে সবাই হাঁফ ছাড়বে, তবে দু-একজন আপত্তি জানিয়ে বলবে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়াটা খুবই নিষ্ঠুর দেখাবে, বরং বাসের একটা সিটে বসে থাকুক। সবাই অফিসে নেমে গেলে তারপর থানায় বা হাসপাতালে পৌঁছে দিলেই হবে। এই কথার পর তর্ক বেঁধে যাবে। তখন ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বাসটা চালিয়ে দেবে। সবাই ড্রাইভারকে তখন, উল্লুক বলবে।
মুকুন্দর মজা লাগছিল এইরকম ভাবতে। কিন্তু সত্যিই যদি থ্রম্বসিসে মারা যেতুম? এই অজিত ধর কি লিফটে উঠতে উঠতে কাউকে বলবে—না মশাই, শরীর আমার ফিট আছে। বারো বছরের কলিগ মুকুন্দ সেন আজ পাঁচ দিন ধরে নিখোঁজ। যা দিনকাল, মার্ডার-টার্ডার হল কি না কে জানে। লোকটা অবশ্য একদিক থেকে ভালোই ছিল, পলিটিক্স করত না তবে মদ-টদ খেত শুনেছি।
আড়চোখে মুকুন্দ তাকাল অজিত ধরের দিকে। শরীর দুর্বল হয়ে যাবে বলে বিয়ে করেনি। শরীর গরম হতে পারে বলে ফুটবল খেলা পর্যন্ত দেখে না। আড়াইটে বাজলেই ড্রয়ার থেকে একটা আপেল বার করে খায়। ওর থ্রম্বোসিস হবে না। ওর ছেলে থাকত যদি, সে বমি করার সুযোগ পাবে না। পকেট হাতড়ে মুকুন্দ কয়েকটা নোট, খুচরো পয়সা আর এলাচের মোড়ক বার করল। এর কোনোটা দিয়েই তাকে আইডেন্টিফাই করা যাবে না। মোড়কটা জনৈক ভোলানাথ গুইয়ের লন্ড্রির বিল। সেটা কুচিয়ে ফেলে মুকুন্দ নিজের নাম-ঠিকানা ইংরেজিতে একটা কাগজে লিখে, বুকপকেটে রেখে স্বস্তি বোধ করল।
অফিস থেকে বেরিয়ে মুকুন্দ শুনল, উত্তর কলকাতায় ট্রাম পুড়েছে তাই ট্রাম বন্ধ। বাস স্টপে গিয়ে দেখল শিশির নামে লিভ সেকশনের নতুন ছেলেটি দাঁড়িয়ে। বছর পঁচিশ বয়স, ফাস্ট ডিভিশনে ফুটবল খেলে। অফিস টিমে খেলবে বলেই চাকরি পেয়েছে। আঁটসাঁট প্যান্ট, নাভির নীচে বেল্ট, উঁচু গোড়ালির ছুঁচোলো জুতো আর ছিপছিপে শরীর। অফিসের মেয়েরা যে ওর দিকে তাকায় এটা ও জানে। কিন্তু শিশির এখন ধুতি-পাঞ্জাবি-চটি পরে দাঁড়িয়ে।