কথা না বলে দীপু হাঁটতে লাগল। ঘাড়টা নামানাে। হাত দুটো আড়ষ্ট। মুখ দেখে কিছু বােঝা যায় না।
পা জ্বলছে। জ্বলুক। ওকথা বললেই বিপদ। ছেলে হয়তাে আবার বলবে ছায়ায় দাঁড়াই। তাহলে বাড়ি পৌঁছােনাে যাবে না। কিংবা হয়তাে চটিটা খুলে দেবে। তার চেয়ে এই ভালো। ওকে কষ্টের কথা জানতে না দিলেই হল। এখন অনেক রাস্তা হাঁটতে হবে। দীপু একটু আস্তে চ।
দীপু দাঁড়াল। কমলা পাশে আসতেই বলল, ওটাকে আমার কাছে দাও।
না রে বড় নরম, পারবি না।
খুব পারব।
বাচ্চাকে দীপুর হাতে তুলে দিল কমলা। আস্তে আস্তে পা ফেলে চলতে লাগল দীপু।
হ্যাঁ রে, তাের মনে আছে বাচ্চুকে একবার ফেলে দিয়েছিলি?
জবাব দিল না দীপু। কথা বলতে গেলে রাস্তা দেখে চলা যায় না ঠিকমতাে। ঠোক্কর খেয়ে পড়লে বাচ্চাটা বাঁচবে না।
ঘ্যানঘ্যান করতিস বােনকে কোলে নেব বলে। একদিন দিলুম কোলে তুলে। ওমমা! দেয়ামাত্তরই যেই দাঁড়াতে গেলি আর টলে পড়ে একশা কান্ড।
শালা খচরা কোথাকার।
ইটটাকে লাথি মেরে দীপু ফুটপাথ থেকে রাস্তায় পাঠাল। হাতের পুঁটলিটা দুলিয়ে কমলা একটা খুকির মতাে হাসল। পায়ের তলার জ্বলুনিটা সয়ে এসেছে। রাস্তার সবটাই তাে আর তেতে নেই। মাঝে মাঝে ছায়া আছে, জল আছে, মার্টিও আছে।
আচ্ছা বল তাে, এখন যদি তাের বাবার সঙ্গে দেখা হয়, কিংবা দারােয়ানটা এসে যদি বকশিশের ভাগ দিয়ে যায়। তাহলে টাসকি করে বাড়ি যাওয়া যায় না রে?
দীপুর দিকে আড়ে তাকিয়ে কমলা কুট করে বিস্কুট কামড়াল। তারপর আবার খুকির মতাে হাসল।
শবাগার
মুকুন্দ খবরকাগজের প্রথম পাতায় চারটি মৃত্যুসংবাদ দেখল, বাসিমুখেই। দুজন বিদেশি মন্ত্রী, একজন বাঙালি ডাক্তার ও কেরলের জনৈক এমপি। চার জনই করোনারি থ্রম্বোসিস-এ। ওদের বয়স ৭২, ৫৫, ৫৮ ও ৫৬। মুকুন্দর বয়স ৫১, কিন্তু সে ব্যাঙ্কের প্রবীণ কেরানি। থাকে পৈতৃক বাড়িতে, ছোটো সংসার, এক তলা ভাড়া-দেওয়া।
দোতলার রান্নাঘর ও কলঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে সে চিন্তিত স্বরে লীলাবতীকে উদ্দেশ করে বলল, থ্রম্বোসিস-এ আজকাল খুব মরছে।
লীলাবতী চা তৈরিতে ব্যস্ত। বলল, কে আবার মরল?
হাঁ-করে ভিতরের পাটিতে বুরুশ ঘষতে ঘষতে মুকুন্দ বলল, খবরের কাগজে দিয়েছে, চারজন।
থ্রম্বোসিস হয়েই তো ছোটোঠাকুরঝির শ্বশুর আপিস যাওয়ার সময় বাসের মধ্যে মরে গেল। পাশের লোকটা পর্যন্ত টের পায়নি। কী পাজি রোগ রে বাবা!
এরপর লীলাবতী যা-যা বলবে মুকুন্দর জানা আছে। কী দশাসই চেহারা ছিল, কী দারুণ রগড় করত, কী ভীষণ খাইয়ে ছিল ইত্যাদি। এক-তলার কলঘরের ছিটকিনি খোলার শব্দ হতেই মুকুন্দ বারান্দার ধারে সরে এল। শুকনো শাড়িটা আলগা করে সদ্যস্নাত দেহে জড়িয়ে শিপ্রা বেরোচ্ছে। হাতে গোছা করে ভিজে কাপড়। শীতলপাটির মতো গায়ের চামড়া, দেহটি নধর। লীলাবতী রান্নাঘর থেকে একটানা কথা বলে যাচ্ছে। মিরা স্কুলে যাবার জন্য আয়নার সামনে। মনু তার ঘরে এখনও ঘুমোচ্ছে।
শিপ্রা উঠোনের তারে কাপড় মেলে দিতে দিতে মুকুন্দকে দেখে দ্রুকুটি করেই হাসল। গোড়ালি, মুখ ও দুটি হাত তোলা। চিবুক এবং বগলের কেশ থেকে জল গড়াচ্ছে। হাসতে গিয়েই ভারসাম্যটা টলে গেল সামান্য। তাইতে ওর বুক ও পাছার যৎসামান্য কম্পনটুকু উপভোগ করতে করতে মুকুন্দ মাজনের ফেনা গিলে, চেটো দিয়ে কষ মুছে নিয়ে হেসে লীলাবতীকে বলল, এর থেকেও পাজি রোগ ক্যানসার। নীচের ভাড়াটে শিপ্রার স্বামী গৌরাঙ্গকে দিন কুড়ি আগে জবাব দিয়ে ক্যানসার হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন দিন গুনছে। লীলাবতী গলা নামিয়ে বলল, যা অবস্থা দেখলুম, মনে হচ্ছে এ মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। বউ-মেয়ের যে কী দশা হবে এরপর! মনুকে তুলে দাও তো, চা হয়ে গেছে।
মনুকে ডাকতে গিয়ে মুকুন্দ দরজার কাছে থমকে গেল। কাত হয়ে খাটে ঘুমোচ্ছ, লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে উঠে রয়েছে। বাইশ বছরের ছেলে, কলেজে পড়ে। ঈষৎ গম্ভীর প্রকৃতির। বাপের সঙ্গে কম কথা বলে। মুকুন্দ সন্তর্পণে লুঙ্গিটা নামিয়ে মনুর কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ওঠ, চা জুড়িয়ে যাচ্ছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে কলঘরে মুখ ধুতে যাবার সময় মুকুন্দ দেখল, মেয়ের ফ্রকটা তারে মেলবার জন্য শিপ্রা ছুড়ে দিল এবং পড়ে গেল উঠোনের মেঝেয়। মুকুন্দর মনে পড়ল, তারটা এত উঁচু করে বেঁধেছিল গৌরাঙ্গই। ও খুব লম্বা। তখন ওর ক্যানসার ধরেনি।
দোতলা থেকে সিঁড়িটা এক-তলায় এসে ঠেকেছে শিপ্রাদের দরজার পাশেই। ডান দিকে ঘুরে গেছে হাত-পনেরোর একটা গলি সদর দরজা পর্যন্ত, বাঁ-দিকে উঠোন ও শিপ্রার রান্নাঘর। মুকুন্দ বাজারের থলি হাতে নীচে নামতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আজ কিন্তু রেশন তোলার শেষ দিন, নইলে হপ্তাটা পচে যাবে।
অফিস যাবার সময় দেব। বলেই মুকুন্দ ওর পাছায় হাত রাখল।
ধ্যাত। শিপ্রা ফাজিল হেসে ছিটকে সরে গেল।
সদর দরজার গায়েই শিপ্রাদের ঘরের জানলা। মুকুন্দ এক বার তাকাল। গৌরাঙ্গ বুকের ওপর হাত রেখে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে। বাজার থেকে ফেরার সময়ও সে তাকাল। গৌরাঙ্গ জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে, চোখ দুটো কঠিন বরফের মতো ঝকঝকে। যেন শীতল ক্রোধ জমাট বেঁধে রয়েছে। অফিসে যাবার সময় মুকুন্দ শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নামল। শিপ্রা দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে ঘরের দরজাটা ভেজানো। মুকুন্দর হাত থেকে দশ টাকার নোটটা নেওয়ামাত্রই শিপ্রাকে সে জড়িয়ে ধরল। চুমু খেতে যাবে, কিন্তু শিপ্রার দৃষ্টি আকর্ষণ করে পিছন ফিরে তাকিয়েই তার বুকের মধ্যে প্রচন্ড এক বিস্ফোরণ ঘটল। মনু সদর দরজার কাছে। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। মুকুন্দর শরীরের মধ্যে তখন ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে মাথায় উঠছে, হাড় থেকে মাংস খুলে খুলে পড়ছে।