কেন যে এমন করে। এতে আমার কী দোষ, আমি কী করতে পারি, উঁ?
ফুটপাথের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে নিজের মনেই কমলা বলল। বাচ্চার গলায় সুতাের মতাে ময়ল্লা। সাবধানে তুলে ফেলে দিল। মাথায় হাত বােলাল। চুল নেই বললেই হয়। দীপুটারও ছিল না।
আস্তে আস্তে কমলার শুন্য চোখ ভরাট হয়ে উঠল। হাসল সে।
তাের বেলায় টাসকি করে এসেছিলুম।
সেকথা তাে বললে।
বলেছি না কি! তুই এর থেকেও বড়ােসড়াে হয়েছিলি, বলেছি? হয়েই কী কান্না। এটা কিন্তু একদম কাঁদেনি।
বাচ্চার ঠোঁট নড়ছে। বােধ হয় খিদে পেয়েছে। কমলা মাই গুঁজে দিল ওর মুখে। দীপু আড়চোখে দোকানির দিকে তাকাল। এইদিকেই তাকিয়েছিল, চোখে চোখ পড়তেই কাগজটা তুলে ধরল।
তাের ষষ্ঠী পুজোর দিন একটা ধনেখালি ডুরে পেয়েছিলুম। ঠাকুরঝির বিয়েতে খোঁচা লেগে ছিড়ে গেছল। পর্দা করেছিলুম।
আমাদের পর্দা ছিল!
জানলায়। ঘন্টুদের বাড়িতে একটা লােক তখন ভাড়া ছিল, খালি তাকাত।
কমলার খেয়াল হল চটিটা এখনও পড়ে আছে। খুলে ফেলল।
থাক-না।
না তুই পর। এটা পরলে কেমন কেমন লাগে। পায়ের পাতায় হাত বোলাল কমলা। আঙুলে হাজা, গােড়ালি ফাটা।
আমার জন্যই এই কষ্ট না রে?
তােমার জন্য কেন হবে।
দীপু মাথা নামিয়ে পায়ের আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঘষতে শুরু করল। কমলা মুখ তুলে তাকাল আকাশে। গরমে চোখ পাতা যায় না। তাকাল ফুটপাথে। সেই বসন্তের ঘায়ের মতাে দাগ। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, কষ্ট কি আমি ইচ্ছে করে দিই, সংসারে দুখু বাড়ুক তা কি আমি চাই। কিন্তু তার বাবার যে একটুও কান্ডজ্ঞান নেই। বারণ করলে রেগে ওঠে।
যার কান্ডজ্ঞান নেই তার রাগারও কোনাে মানে নেই। আপিসে বসে মজা দেখছে হয়তাে, আর আমরা এখানে…
মুখ তুলল কমলা। ছেলের চোখে রাগ, ধমকানি, দুঃখ। ও এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। ধক করে উঠল কমলার বুক। ছেলেকে আর এখন চেনা যাচ্ছে না। মস্তবড়াে হয়ে গেছে। বুঝতে শিখেছে, ধমকাতে শিখেছে। কিন্তু ও ধমকাচ্ছে কাকে! আমাকে? আমি কী দোষ করেছি! ইচ্ছে করে কি সংসারে অশান্তি এনেছি? ছেলেটা বাপের স্বভাব পেয়েছে, সবটাতেই রেগে ওঠে। এইটুকু ছেলে রাগে কেন? ওকি সংসারের হালচাল বুঝে ফেলেছে?
কমলা চুপ করে তাকিয়ে রইল। রাস্তার ওপারে ফুটপাথে ছায়া। খাটিয়ায় একটা লােক শুয়ে। কাঠ কাটছে একটা মেয়েমানুষ। হঠাৎ দমকলের ঘণ্টা বাজল। গাড়িগুলাে রাস্তার কিনার ঘেষে এল। ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল একটা দমকলগাড়ি।
আহারে! কাদের আবার কপাল পুড়ল।
যাদেরই পুড়ক-না, তােমার কী?
ক্ষতি তাে হবে!
হােক গে, তা ভেবে আমাদের কী হবে, বাড়ি পৌঁছােতে পারব কি?
ছেলের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেছে। খিদে পেয়েছে। পিচ গলে যাওয়ায় চড়বড় শব্দ হচ্ছে। গাড়ির চাকায়। এখন অনেকখানি পথ হাঁটলে তবে বাড়ি পৌঁছােনাে যাবে। ছেলে মেয়েগুলােকে শিকলি দিয়ে ঘরে আটকে রেখে এসেছে। তাদের খাওয়া হয়নি। গিয়ে উনুন ধরিয়ে বেঁধে খাওয়াতে হবে। ওরা এতক্ষণ কী করছে কে জানে। হুটোপাটি করে ঘরের জিনিস ভেঙেছে। বালিশ নিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলেছে। নিতুটার ভীষণ লােভ চিনিতে। দেয়ালে পা দিয়ে দিয়ে উঠে হয়তাে শিশিটা সাবড়ে দিয়েছে। বাছুর ঘরকন্নার কাজ খুব পছন্দ। কুজো থেকে জল ঢেলে, জামাটামা কিছু একটা দিয়ে ঘর মুছতে শুরু করেছে। কিন্তু কতক্ষণ ওরা খেলা করবে। খিদে পাবে, চিৎকার করবে, কাঁদবে। ওরা তাে সবসময়ই চ্যাঁচায়। পাশের বাড়ির লােকেরা শুনলে গ্রাহ্যই করবে না। হয়তো তারপর কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়বে। নিতুটা আগে ঘুমােবে। ওর স্বাস্থ্যটাই ভালাে। অপুকে হয়তাে বাছুই ঘুম পাড়িয়ে দেবে। জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাচ্চুটাও ঘুমিয়ে পড়বে একসময়।
আবার উঠছ কেন?
আর বসে থাকতে পারছি না রে। আমার কষ্ট হচ্ছে।
হচ্ছে তাে যাও, আমি উঠতে পারব না।
তুই অমন করে আর কথা বলিসনি।
কেন বলব না, কেন পয়সা পর্যন্ত চেয়ে রাখ না?
আমায় যদি না দেয় কী করতে পারি।
তুমি একটা বােকা। মান-ইজ্জতটাই তােমার কাছে বড়াে, নইলে দারােয়ানটা পর্যন্ত…
ফ্যালফ্যাল করে কমলা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। …ও বলছে আমি বােকা। তাহলে একটু আগে কেন আমায় চটি পরতে দিয়েছিল? ওর নিজের পা পুড়বে তা কি ও জানত না?…
মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে দীপু। কমলার চোখ টলটল করছে। দোকানি টেবিলে থুতনি রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। এতক্ষণে একটাও খদ্দের আসেনি।
রােগা জিরজিরে একটা গােরুকে দুটো লােক টানতে টানতে নিয়ে এল। ইলেকট্রিক পােস্টে বেঁধে লােক দুটো এপার-ওধার তাকাচ্ছে। মুচকি হেসে গেল এক পিয়ােন। খাটিয়ায় শােয়া লােকটা উঠে বসেছে। উরু থাবড়ে চা-ওয়ালাকে ডাকল। সামনের বারান্দায় ঘোমটা দিয়ে এক বউ এসে দাঁড়াল।
শালা যা গরম পড়ছে! না যায় ঘরে বসে থাকা, না যায় বাইরে বেরােনাে।
লুঙ্গির কষি আটতে আটতে দোকানি বেরিয়ে এল। গােটা চোখ বুজে জাবর কাটছে।
উধার দেখাে। গলিকা ভিতর এক ঠো হ্যায়।
দোকানি হাত তুলে কাছের গলিটা দেখিয়ে দিল। দুটো লােকের একজন সেইদিকে গেল। একটা মাছি বসেছে গােরুটার পিঠে। থরথরিয়ে চামড়া কাঁপাল। উঠে দাঁড়াল দীপু। হনহন কার খানিকটা গিয়ে পিছু ফিরে তাকাল। কমলা সঙ্গে আসেনি।
কী জন্য দাঁড়িয়ে আছ? চলে আসছ না কেন?
কাছে এসে কমলা বলল, তুই হঠাৎ এমনভাবে হাঁটতে শুরু করে দিলি যে?