ওই বারান্দাটার তলায় দাঁড়াই।
মাথা নামিয়ে চলছিল কমলা। চলতেই লাগল। ওর হাত ধরে দীপু ছায়ায় টেনে আনল।
হেঁটে বাড়ি যাওয়া যাবে না।
এই তাে যাচ্ছি।
রেগে গেছ বলে কষ্ট লাগছে না। সারা রাস্তা তাে আর রাগতে রাগতে যাওয়া যায় না।
তবে কী করব?
ফিরে যাই। হয়তাে বাবা এসে পড়েছে; তাহলে ট্যাক্সিতে যাওয়া যাবে।
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কমলা। রাগ করে চলে আসাটা বােধ হয় ঠিক হয়নি। এমন করে বাড়ি পৌঁছােনাে যায়। যেতে যেতেই পায়ের তলা ঝলসে যাবে। শরীরের ব্যথাও মরেনি, চলতে কষ্ট হয়। এত গরম বাচ্চাটাই-বা সইবে কী করে।
ওদের দেখে দারােয়ান কাছে এল। দীপুকে লক্ষ করে জিজ্ঞেস করল, গেলে না যে? চুপ করে রইল দীপু! এবার কমলাকে সে জিজ্ঞেস করল, নিতে আসার কথা আছে বুঝি?
হ্যাঁ।
দারােয়ান চাবির তােড়া বাজাতে বাজাতে চলে গেল। কোথা থেকে কান্নার শব্দ আসছে। শব্দটা এগিয়ে আসছে। এসে পড়ল। দুই বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। রাস্তা থেকে লরির টায়ার ফাটার শব্দ এল। কাক ডাকছে।
ব্যাটা দরদ দেখিয়ে গেল।
কেন?
আমি না থাকলে ওর বকশিশ জুটত না।
লােক ডেকে গাড়ি ঠেলত।
তাদের তাে পয়সা দিতে হত।
হলকা আসছে। বাপ্পাটা আরও ছােটো হয়ে গেছে যেন। বুকের আরও কাছে কমলা জড়িয়ে ধরল। দীপুর কানের পিছন দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। আঁচল তুলে মুছিয়ে দিতে গেল, মাথা সরিয়ে নিল দীপু। জামার হাতায় মুছে নিল।
একটা রিকশা করে চলে যাই চলাে।
পয়সা?
তুমি তাে জমিয়ে রাখ।
কে বলল?
সেদিন দুপুরে যে বাসনওলাকে ডাকলে?
সে তাে অমনি ডেকেছিলুম, কিনেছি না কি?
তাহলে দোতলার বউদির কাছে ধার নিলেই হবে।
ধার করতে হবে না।
তা বলে সারাদিন এখানে বসে থাকব না কি?
তুই অত রেগে উঠছিস কেন? অধৈর্য হাস কেন? দ্যাখ-না উনি হয়তাে এসে পড়বেন।
আমার খিদে পেয়েছে।
দীপু প্ৰত এসে ফুটপাথে দাঁড়াল। কমলা আসতেই চটিটা খুলে এগিয়ে দিল।
কী হবে?
পরো, নইলে চলবে কী করে?
তুই?
ততক্ষণ দীপুর পায়ের চোটো জ্বলতে শুরু করেছে। ছুটে সে গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তার গাছ। লিকলিকে তার ছায়া।
দাঁড়িয়ে কেন, হাঁটতে আরম্ভ করাে।
অবাক হয়ে কমলা ওর কান্ড দেখছিল। চটিপরা অভ্যাস নেই। আঙুল দিয়ে ফিতেটাকে আঁকড়ে থাপথপিয়ে একটু হেঁটেই থেমে গেল। দীপু পায়ে পা ঘষছে। হেসে ফেলল কমলা।
ধ্যাত, আমি কি এমনভাবে চলতে পারি?
নইলে দেরি হয়ে যাবে। অপু, নিতুদের এখনও খাওয়া হয়নি।
গাছের ছায়ায় কমলা এসে পৌঁছােতেই দীপু আবার ছুট লাগাল অনেক দূরে একটা হাইড্রেট লক্ষ করে। দুটো লােক স্নান করছে। জলে পা ভিজিয়ে দীপু দাঁড়াল। কমলা অনেক দূরে। ছেলে কোলে, পুটলি হাতে থপথপিয়ে আসছে। দু-হাতে জল নিয়ে দীপু মাথায় থাপড়ল।
অ দীপু, অমন করে তুই কত ছুটবি?
দাঁড়ালে কেন, হাঁটো।
নিতুটাকে বার্লি দিয়েছিস তাে?
হ্যাঁ।
ওরা চৌবাচ্চায় নামবে না তাে?
না না না, তুমি হাঁটো।
আবার ছুটল দীপু। এবার একটা রিকশার আড়ালে। রিকশাওয়ালা হুড ফেলে সিটের উপর বসেছিল। কমলাকে তার দিকে তাকিয়ে আসতে দেখে নেমে দাঁড়াল। দীপুও লক্ষ করেছে কমলা রিকশাটার দিকে কেমন কেমন করে তাকাচ্ছে।
মা, রিকশায় ওঠো।
ধার করলে তার বাবা রাগ করবে।
জানবে কী করে?
তাহলে কার কাছ থেকে নিয়ে ধার শুধবি?
তবে বাবা এল না কেন? কেন আমায় পয়সা না দিয়ে পাঠাল?
চিৎকার করল দীপু। চোখে জল এসে গেছে। ঠোঁট কাঁপছে।
অ দীপু, তুই চুপ কর।
কেন করব? তােমার জন্যই তাে এই কষ্ট। দারােয়ানটার কাছ থেকে ঠিক ভাগ আদায় করে নিতুম।
দীপু তুই রিসকায় ওঠ, আমি ধার শােধ করে দেব।
দীপু রিকশার ছায়া থেকে বেরিয়ে নর্দমায় পা রেখে দাঁড়াল।
লক্ষ্মীছেলে আমার।
না।
দীপু চোখ সরিয়ে নিল। কমলার চোখের থেকে দূরের রাস্তা অনেক ঠাণ্ডা। রিকশাওয়ালা সিটে উঠে বসল। ঘাম গড়াচ্ছে কমলার গাল বেয়ে। ভুরু ভিজে গেছে। চোখ জ্বলছে। ঘাড়ে চোখ ঘষল। চোখ দুটো গর্তে বসে গেছে। শুকনাে বাতাসে চুল উড়ে পড়ল কপালে। ঠোঁট চাটল কমলা। গলার নলিটা তুলতুল করে কাঁপছে।
এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে, চল ওখানটায় বসি।
মনােহারী দোকানটার সিঁড়িতে ছায়া। দীপু সিঁড়িতে বসল। কমলা এল না। উঠে এসে দীপু এর হাত ধরে টানল।
আমি যাব না।
মাকে দু-হাতে জড়িয়ে দীপু টেনে আনল। দোকানি খবরের কাগজ পড়ছিল। ওদের দেখে নিয়ে আবার পড়তে শুরু করল।
মা তােমার খিদে পেয়েছে?
না।
না কেন, এত বেলা হয়েছে।
বেলায় খাওয়া আমার অভ্যেস।
ঘাড় ফিরিয়ে কমলা দোকানের ভিতর তাকাল। সারি সারি বয়ামে বিস্কুট আর টফি।
তাের খিদে পেয়েছে?
না।
বললেই বিশ্বাস করব! সাড়ে নটাতেই ভাত ভাত করে চিৎকার করিস না?
তােমারও তাে পেয়েছে।
আমার গা গুলােচ্ছে। খেলে বমি হয়ে যাবে।
আঁচল থেকে বারােটা পয়সা খুলে নিল। বিস্কুট কিনল দীপু। খেতে খেতে আড়চোখে দেখল কমলা তার খাওয়া দেখছে। দুর্গা প্রতিমার মতাে হাসিটা, মানে বােঝা যায় না। শেষ বিস্কুটটা এগিয়ে দিল দীপু।
না, তুই খা।
বাচ্চার বুকের ওপর বিস্কুটটা রাখতেই গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কমলা ধরে ফেলল। দীপু মুখ ঘুরিয়ে সরে বসল। জিভ দিয়ে মাড়ি পরিষ্কার করে, টাকরায় শব্দ করল।
কমলা তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে একদৃষ্টে। ফুটপাথে বসন্তের ঘায়ের মতাে দাগ। অনেক দিনের অনেক লােকের হাঁটাচলার জায়গায় জায়গায় দাগগুলাে মিলিয়ে গেছে। দীপুর বাবার মুখের দাগগুলো এখনও মেলায়নি। তখন অনেকেই বলেছিল কচি ডাবের জলে মুখ পুতে, ধােয়নি। এই ফুটপাথের মতাে হয়ে আছে ওর মুখটা। মানুষটাও খ্যাপাটে হয়ে গেছে। খেপলে মুখটা বাটনা বাটা শিলের মতাে হয়ে যায়। একঘেয়ে, রােজকার অভ্যাস। আয় বাড়ছে না, ঘর বাড়ছে না, খাটুনিরও কামাই নেই।