হ্যাঁ রে দীপু ট্যাসকির ভাড়া বুঝি কম? সবাই যে গেল।
দীপু সাড়া দিল না। ঘাড় তুলে সে নিয়ম পড়ছে।
এখান থেকে আমাদের বাড়ি যেতে কত নেবে রে?
দীপু এবারও সাড়া দিল না। কমলা দীপুর থেকে চোখ সরিয়ে ফড়িংটার ওপর রাখল, ওটা এইমাত্র মােটারের টায়ারে এসে বসেছে; তারপর রাখল বাচ্চার উপর। বাচ্চাকে দু-হাতে দোলাল। বড়ড হালকা। কালাে বেল্টপরা নার্সটি হেসে বলেছিল, কী সুন্দর বেবি। আহা, বড়াে ভালাে মেয়েটি। বলেছিল দেখা করবে।
কমলা দূরের বারান্দায় তাকাল। একটাও মানুষ নেই। কে থাকবে এই গরমে। তা ছাড়া ওর ডিউটি তাে ওধারে দক্ষিণের বারান্দায়। কালকে এমন সময় দেখা হয়েছিল। কাঁদো কাঁদো মুখ করে ছুটে আসছিল। কে একজন না কি বাড়ি যাবার সময় হাতে আট আনা পয়সা ওঁজে দিয়েছে।
দীপু একটু নজর করিস তাে, সেই কপালে কাটাদাগ আমাদের নার্সটির যদি দেখতে পাস। আমাকে খুব যত্ন করেছিল।
তাকে দেখব কী করে, সে তাে ওয়ার্ডে এখন।
তবু যদি এদিকে এসেটোসে পড়ে। এক জায়গায় বসে তাে আর কাজ করতে হয় না।
দীপু আগের মতো বাম্পারে বসে গাড়ির পিঠে মাথা রাখল।
আর গােটা কতুক পয়সা থাকলে বাসে চলে যেতুম।
কমলা মুখ ফিরিয়ে নিল। পা ছড়িয়ে দিল রােদুরে। সিমেন্ট তেতে উঠেছে। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে সেঁকের কাজ হয়ে যাবে। ঠেস দিয়ে সে চোখ বুজল।
এই ওঠো, ওঠো।
ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে দারােয়ান। যার মােটরগাড়ি সে এসে গেছে। উঠে দাঁড়াতে ভুলে গেল দীপু তার দিকে তাকিয়ে।
লেড়ি ডাক্তার দীপুকে নজর না করেই গাড়িতে উঠে বসল। সেলফ স্টার্টারের বােতাম টিপল। খরখর করে উঠল এঞ্জিন, স্টার্ট হল না।
গাড়ি ঘেঁষে কমলা বসেছিল। লেডি ডাক্তারের মুখটুকু শুধু দেখতে পাচ্ছিল সে। সুন্দর। কপাল, সুন্দর রং, সুন্দর চুল।
আবার শব্দ হল স্টার্টারের। বিচ্ছিরি শব্দ। এত সুন্দর গাড়িটা যেন ককাচ্ছে। বার কয়েক এমন হবার পর লেড়ি ডাক্তার গাড়ি থেকে নামল। নীচু হয়ে গাড়ির তলা দিয়ে কমলা শুধু গােড়ালি আর সায়ার লেস দেখতে পেল।
নাপিত আর দারােয়ান এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে যেন গাড়ি স্টার্ট না হবার দোষটুক তাদেরই। দীপু কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। হঠাৎ মনে হল, তার পা দুটো খুব সরু আর লােম গুলাে বড়ড় ঘন। থুতনিতে বড়াে বড়াে চুল মুখটাকে কুচ্ছিত করে রেখেছে। মােটরের আড়ালে সরে এসে সে গালে হাত বােলাল। আঙুলে একটা ব্রণ ঠেকল।
গাড়িটা একটু ঠেলে দাওনা।
বলার ভঙ্গিটা আবদের। স্বরটা ঠিঠিনে। নাপিত আর দারােয়ান সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। গাড়িটা মস্ত। ওরা দুজনেই বুড়াে। জায়গাটা খাড়াই। ওদের পিঠ বেঁকে গেল, পায়ের ডিম শক্ত হল, তবু গাড়িটাকে নড়ানাে গেল না।
হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, গিয়ে ঠ্যাল-না?
আমি কেন ঠেলব?
আহা, মানুষ বিপদে পড়েছে সাহায্য করবি না। একটুখানি ঠেলে দিলেই বুঝি মান-ইজ্জত খােয়া যায়?
দীপু গিয়ে হাত লাগাল। নড়ে উঠল গাড়িটা। মুগ্ধ কমলা তাকিয়ে রইল দীপুর কনুইয়ের কাছের গুড়িগুড়ি পেশির দিকে। উঁচু দিকটা কাবার হয়, ঢালুতে পড়েই গাড়ির গতি বাড়ল। ঝকা করে ক্লাচ পড়ল। গড়গড়িয়ে উঠল এঞ্জিন। গাড়িটা কিছুটা ছুটে গিয়ে থামল। হাত নেড়ে লেডি ডাক্তার ডাকছে। দারােয়ান আর নাপিত ছুটে গেল। ওদের হাতে কী যেন দিল, বােধ হয় বকশিশশ।
দীপুর হাঁটুর কাছে নুনছাল উঠে গেছে। ক্লাচ দিতে থমকে যায় গাড়িটা, তখনই মাডগার্ডের ধারটা লেগেছিল।
সামনের বাগানটা চক্কর দিয়ে গাড়িটা পুব দিকে চলে গেল। কমলা তাকিয়ে রইল ওইদিকে। অল্প অল্প ধোঁয়ার গন্ধ আসছে। বেশ লাগে শুকাতে।
ওরা পয়সা নিল।
দিল বুঝি?
হুঁ।
ওরা তাে নেবেই।
আমায় দিলে ছুড়ে ফেলে দিতুম।
তােকে দিতই না। শিক্ষিত তাে, মানুষ চেনে। কাকে দিতে হয় না হয় বােঝে।
পয়সাটা দুজনে ভাগাভাগি করে নেবে।
তা তাে নেবেই।
আমায় যদি দিতে আসে?
আসবে না।
আমি না ঠেললে গাড়ি চলত না।
নাপিত আর দারােয়ান এতক্ষণ সেইখানে দাঁড়িয়েই কথা বলছিল। নাপিত চলে গেল। দারােয়ান ওদের কাছে এসে দাঁড়াল।
আপনারা যাবেন কখন?
এই তাে এক্ষুনি যাব।
দেরি করলে আরও গরম পড়বে, বাচ্চার কষ্ট হবে। কাল একশো পাঁচ ডিগ্রি হয়েছিল?
ওরা দুজনেই মুখ ঘুরিয়ে রইল। দারােয়ান টুলে গিয়ে বসল।
কী বলেছিল আসবে তাে?
হ্যাঁ, ছুটি করিয়ে চলে আসবে বলেছিল, বােধ হয় কাজের তাড়া পড়েছে।
জানি, তোকে আর বােঝাতে হবে না। যত কাজ এর আজকেই।
বােধ হয় ছুটি পায়নি। অফিসে খুব গােলমাল চলছে বলছিল। বারাে জনের চাকরি গেছে, সবাই ভয়ে ভয়ে রয়েছে।
একটা দিন ছুটি নিলে কি চাকরি যেত?
উবু হয়ে বসল দীপু। মুখ ফিরিয়ে রয়েছে কমলা। রসালাে লেবু চুষলে অমন হয় ঠোট দুটো। ছেলেমানুষের মতাে দেখতে হয়ে গেছে। দীপু বাচ্চাটার গালে আঙুল ছোঁয়াল। ওকে কনুই দিয়ে ঝটকা দিল কমলা।
মা, তােমাকে এখন তার মতাে লাগছে কিন্তু।
উঠে পড়ল কমলা। কাপড়ের পুঁটলিটা এক হাতে নিয়ে গেটের দিকে চলতে শুরু করল। দীপু পিছু নিল।
কোথায় যাচ্ছ?
কথা বলল না কমলা। গেটের বাইরে এসে দাঁড়াল সে। এপার-ওধার তাকিয়ে দিশা করতে পারল না কোন দিকে যেতে হবে।
বাড়ি যাবে না কি?
হ্যাঁ।
কী করে যাবে?
হেঁটে যাব। কোনদিকে যাব বল?
থুতনি তুলে দীপু উত্তর দিকে দেখাল। হাঁটতে শুরু করে দিল কমলা। পা ফেলছে আর আঙুলগুলাে কুঁকড়ে যাচ্ছে। দীপু চটি থেকে পা বার করে ফুটপাতে রেখেই চমকে তুলে