অ দীপু।
বলেছি তাে, অফিস থেকে ছুটি করিয়ে তবে আসবে।
তােকে একলা পাঠাল কী বলে শুনি? ছেলে-মেয়েগুলাে বাড়িতে এতক্ষণ কী কান্ড করছে কে জানে।
শিকলি দিয়ে এসেছি।
তাতে কী হয়েছে, ঘরের জিনিস ভাঙবে। এত বেলা হল ওদের খিদেও তাে পেয়েছে।
মেয়েটা লালবাড়িতে ঢুকে গেল। সােজা পুবমুখাে রাস্তা ধরে ছেলেটা চলে যাচ্ছে। হাতের নলটা দোলাচ্ছে। দীপু পুব দিকে তাকিয়ে রইল।
কমলা দেখছে সবুজ শাড়িপরাটিকে। গাড়িবারান্দার নীচে আরও তিনটি বউ বসে। সবাই মাঝবয়সি। শুধু একে দেখেই মনে হচ্ছে প্রথম পােয়াতি। চোখে-মুখে ভয় এখনও কাটেনি। বাচ্চাটাকে পর্যন্ত ভরসা করে কোলে নেয়নি। নাতি কিংবা নাতনিকে কোলে নিয়ে দোলাচ্ছে বুড়িটা।
খস করে ট্যাক্সিটা থামল। তর সইছে না ছেলেটার। নেমেই তাড়া দিল ওঠার জন্য। হাসপাতালের বুড়াে দারােয়ান ট্যাক্সির দরজা খুলে ধরেছে। বউকে দু-হাতে ধরে তুলল। দু
পাশে তাকিয়ে বউটা স্বামীর হাত দুটো সরিয়ে দিল।
বুড়ি ট্যাক্সিতে উঠতে পারছে না। হাতজোড়া বাচ্চা। মাথা নীচু করে বুকলে, খাড়া থাকার মতাে জোর আর কোমরে নেই।
আপনি ছেলেকে ধরুন-না। উনি উঠলে পর কোলে দেবেন।
কমলার পরামর্শ শুনল ছেলেটা। দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল দারােয়ান। একটা টাকা বকশিশ পেল।
জানলি দীপু, তােকে নিয়ে ওঠবার সময় টাসকির দরজায় মাথা ঠুকে গেছল। খিঁচিয়ে উঠেছিল তাের বাবা। এমন রাগ ধরেছিল তখন, মনে হয়েছিল দিই তােকে ফেলে, যেদিকে দু-চোখ যায় চলে যাই।
বাবার স্বভাবটা বড়াে বিচ্ছিরি।
তাের ঠাকমা খুব বকেছিল তার বাবাকে। হ্যাঁ রে, মনে আছে ঠাকমাকে? আমায় খুব ভালবাসত।
তুমি ট্যাক্সি করে গেছলে!
এর থেকে বড়াে ছিল টাসকিটা। তাের মেজোমামা, সােনাপিসি সব্বাইকে ধরে গেছল।
নিতু, অপু, বাচ্চু এরাও ট্যাক্সিতে গেছল?
শুধু নিতুটা গেছল, আর সব রিসকোয়।
কমলা তার বাচ্চাকে কোল থেকে হড়ানাে পায়ের উপর শুইয়ে দিল। নাপিত নখ কাটছে ফর্সা বউটার। ওর গায়ে জামা নেই, শরীরেও মাংস নেই। একলা বসে। স্বামী গাড়ি ডাকতে গেছে। নাপিতটা নতুন। মাথায় টিকি। টিকিওলা নাপিত কমলা কখনাে দেখেনি। বার সময়ে ছিল বেঁচে গাট্টাগােট্টা এক নাপিত। পােয়াতিরা খালাস হয়ে যাবার সময় এখানেই নখ কেটে যায়। সে-বার ঝগড়া হয়েছিল। দু-আনার জন্য দীপুর বাপ হাতাহাতি করতে গেছল।
হ্যাঁ রে দীপু দ্যাখ-না ক-পয়সা নেয়।
কী হবে দেখে।
তাহলে এখানেই কেটে নােব।
দীপু উঠে গেল। একটা রিকশা নিয়ে এল বউটার স্বামী। দারােয়ান গাড়িবারান্দার তলায় রিকশাকে দাঁড়াতে দিল না। বউকে ধরে নিয়ে গেল লােকটা। কোমর ভেঙে গেছে। ধুকতে ধুকতে হাঁটছে। হঠাৎ কাপড়টা আলগা হয়ে পড়ছিল, একহাতে বাচ্চাকে অন্যহাতে কাপড়টা ধরে সে অসহায় চোখে কমলার দিকে তাকাল।
অ দীপু, ভাইকে একটু ধর তো।
বাচ্চাকে দীপুর কোলে দিয়ে কমলা গিয়ে বউটাকে কাপড় পরিয়ে দিল। হ্যাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। কমলা ধরে নিয়ে গেল রিকশা পর্যন্ত। উঠতে পারছে না। রিকশাগুলাে এমন গড়ানে হয় যে কমজোরি লােক উঠতে গেলেই টলে পড়ে। বাচ্চাকে চেয়ে নিল কমলা। হামাগুড়ি দিয়ে বউটা রিকশায় উঠল। ওর স্বামীও উঠল। কমলা বাচ্চাকে কোলে তুলে দিল।
আসি দিদি।
নামবার সময় সাবধানে নেবাে।
রিকশাটা চলে গেল। আবার একটা ট্যাক্সি এল। হাতআয়নাটা বাস্কেটে রেখে বাচ্চা বউটা উঠে দাঁড়াল। বেশ শক্তসমর্থ গড়ন। কোন ফাঁকে বুকটাকে আঁটসাঁট করে নিয়েছে। বাচ্চাকে স্বামীর কোলে দিয়ে গটগটিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল।
চলে গেল ট্যাক্সিটা। দরজা বন্ধ করে বকশিশ পেল দারােয়ান। এখন গাড়িবারান্দার তলায় বাড়ি যাবার জন্য রইল শুধু কমলা।
দীপুর কাছ থেকে ছেলেকে কোলে নিয়ে মােটরের ধার ঘেঁষে কমলা মেঝেয় বসল। দীপু বসল বাম্পারে। দারােয়ান বসেছে তার টুলে আর নাপিত সিঁড়িতে। হাসপাতালের ভিতর থেকে টুকটুক করে একটা বেড়াল নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গে এক মাঝবয়সি দাই এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে গেল। খিলেনের কার্নিশে দু-তিনটে কাক উঠে এল। অনেক দূরে, গােলাপি বেল্টআটা সাদা কাপড়ের টুপিপরা পাঁচ-ছটি মেয়ে খাতা হাতে চলে গেল। উত্তরের ছাই রঙের বাড়িটার তিন তলার বারান্দায়, টেবিল ঘিরে তাস খেলছে ক-জানে।
নাপিতটা কত নিল রে?
আট আনা।
তাের বাবা ভােলাকে বলে রেখেছে তাে?
কী জানি। ভােলা তাে বারােটা পর্যন্ত পাড়ায় থাকে। এখন গেলে হয়তাে পাওয়া যাবে।
দ্যাখ-না একটু, তাের বাবা আসছে কি না।
দেখলেই কি বাবা তাড়াতাড়ি আসবে?
দীপু ঝেঁঝে উঠল। বাতাসে হলকা আসছে। বাচ্চাকে আঁচল দিয়ে কমলা ঢেকে দিল। উত্তর-পুবের লালবাড়িটা থেকে তরতরিয়ে দুটি মেয়ে নেমে গেল। দীপু ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে রইল। একটু গিয়েই ওরা বেঁকে গেল।
মা তােমার কাছে পয়সা আছে?
বারােটা পয়সা আছে। কেন?
কতক্ষণ বসে থাকব?
উনি কখন আসেন, কে জানে।
হেসে উঠল নাপিতটা। আর খদ্দের নেই তবু বসে গল্প করছে। দারােয়ানকে খুশি না রাখলে এখানকার পসার বন্ধ হয়ে যাবে। দীপু উঠে গিয়ে দরজার পাশে টাঙানাে রুগি দেখবার নিয়ম পড়তে শুরু করল। কমলা তাকাল বাগানের দিকে। হাওয়া আসছে, তবু গলগলিয়ে ঘাম নামছে। চমকে উঠে হাত ছড়ল বাচ্চাটা। স্বপ্ন দেখছে। বােধ হয় গতজন্মের কথা ভাবছে। ঠোঁট নড়ছে। হাসছে। না কি খিদে পেয়েছে। মােটরটার দিকে পিছন ফিরে মুখে মাই গুজে দিল কমলা। চনমন করে মুখ সরিয়ে নিল। চোখ বুজেই আছে। বড়ড় আলাে, কচি চোখে সইবে কেন। আঁচল দিয়ে বাচ্চাকে আবার ঢেকে দিল কমলা। আঁচলের নীচে নড়ছে। আঁচল ফাঁক করে দেখল। হাত-পা কুঁকড়ে গুটিয়ে রয়েছে। কালাে ঠোঁট দুটো নড়ছে। কী ছিল ও আগের জন্মে, রাজার ছেলে? গতজন্মের কথা মনে পড়ে হাসছে?