এমন আকস্মিকভাবে ব্যাপারটা হয়ে চলল যে ওরা দুজন এক-পা হটার কথাও ভাবতে পারল না। ছোরার ডগাটার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকল। শেষে বউদিই বলল, টাকা তো আমাদের কাছে নেই। পুলিশে জমা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাজে কথা রাখুন। সব খবর রাখি। টাকা এই বাড়িতেই আছে। চটপট বার করুন, জানেন তো এর জন্যে খুন পর্যন্ত হয়ে গেছে। আরও খুন হতে পারে।
টাকা বাপু আমার বড়ছেলে নিয়েছে। আমরা ও-টাকা চাই না।
মিথ্যে কথা। হাত দিয়েও উনি টাকা এখন পর্যন্ত ছাঁননি, আর কিনা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন?
কেন, ও কি টাকার বদলে বাড়ির অংশ ছাড়বে বলেনি? ছাড়ক, তবে তো টাকা পাবে। আগেই বলছেন কেন টাকা নিয়েছে? দশ হাজার টাকার বদলে পনেরো হাজার টাকার বাড়ির অংশ নিচ্ছেন, এত বড়ো জোচ্চুরির পরও কিনা বলছেন আপনার ছেলে টাকা নিয়েছে?
টাকা যে দেওয়া হচ্ছে এই ওর ভাগ্যি। বাড়ি ওর বাপের, সে যদি উইল করে ওকে বঞ্চিত করে তাহলে ও কী করবে শুনি?
করে দেখুন-না। কোর্টে গিয়ে আদায় করব।
তোমার চোদ্দোপুরুষের সাধ্যি নেই আদায় করে।
মুখ সামলে কথা বলবেন বলছি।
চুপ কর হারামজাদি।
এরপর বউদি কয়লা ভাঙার লোহাটা ছুড়ে মারে। মা কপাল চেপে ঘুরে পড়ে বার কয়েক হাত-পা খিঁচিয়েই নিথর হয়ে গেল দেখে গুণ্ডাটা ছুটে এল। নাড়ি টিপে, চোখের পাতা তুলে, বুকে কান রেখে সে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, একেবারে মার্ডার করে দিলেন। যাক চটপট আমার থলেটা বার করে দিন তো, চলে যাই।
আমি এখন কী করব?
আমি কী জানি? আমার থলেটা দিন।
ডাক্তার ডাকব?
বললুম তো জানি না।
পুলিশ?
কী বলবেন ডেকে? খুন করেছি? তাহলে তো আপনার ফাঁসি হবে।
এই সময় ছাদ থেকে খুকি নামল। মাকে রক্তের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখে হাউহাউ করে উঠে বলল, ওমা, কে তোমার এমন কান্ড করল?
ওই তো, ওই লোকটা, সেই গুণ্ডাটা!
বউদির আঙুল তোলা দেখে গুণ্ডাটা খুব ঘাবড়ে গেল। তার মানে, এসব কী কথা? বলতে বলতে পিছোতে শুরু করল। খুকি চিৎকার করে ছুটে গিয়ে লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বউদিও ছুটে গেল।
জানো ঠাকুরঝি, খটাং করে লোহাটা দিয়ে মারল। কীরকম শব্দ যে হল।
খুকিকে এক হাতে আটকে গুণ্ডাটা খিল খুলতে যাচ্ছে, বউদি খিল চেপে ধরে বলল, আবার আমার ঘাড়ে দোষ দেবার চেষ্টা করছে। কী বদমাস দেখেছ!
মা কালীর দিব্যি, আমি করিনি।
না করেনি, পাজি গুণ্ডা কোথাকার। টাকা দিন নইলে খুন করব বলে ওটা ছুড়ে মারলে না?
চিৎকার করতে করতে খুকি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে। গুণ্ডাটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। খুকির চিৎকারে আশপাশের বাড়ির জানলায় ছাদে উঁকি শুরু হয়ে গেছে। সদর দরজার কাছে কাদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। গুণ্ডাটা হঠাৎ সংবিৎ পেয়ে এধার-ওধার তাকিয়েই ছাদে যাবার জন্য ছুটল সিঁড়ির দিকে। বউদিও পিছু নিল।
পালাচ্ছ নাকি? কোনো উপায় নেই, ছাদ দিয়ে শুধু রাস্তায় লাফিয়ে পড়া যায়। সেখানে এখন লোক।
তাই যাব। ছুরি দেখিয়ে পালাব। মরিয়া হয়ে গুণ্ডাটা বলল।
আমার কী দোষ! চোদ্দোপুরুষ তুলে গালাগাল দিলে রাগ হবে না? তোমার হত না?
গুণ্ডাটা জবাব না দিয়ে কয়েক ধাপ ওঠা মাত্র বউদি ওর জামা টেনে ধরল। এখন তোমায় আমি যেতে দিতে পারি না। খুনি তোমার হতেই হবে। ফাঁসি অবধারিত তোমার।
তাহলে পুলিশকে বলব লুটের টাকা এ বাড়িতে আছে।
তার আগেই সরিয়ে ফেলব অন্য কোথাও।
এখুনি চেঁচিয়ে সব কথা লোকেদের বলে দিচ্ছি। ফাঁসি যখন হবেই আর পরোয়া কীসের। তবে আপনাদেরও টাকা ভোগ করতে দেব না।
কিন্তু তাই বলে আমি ফাঁসি যেতে রাজি নই, তোমাকেই ফাঁসি যেতে হবে। লোকে সহজেই বিশ্বাস করবে তোমার পক্ষে খুন করা স্বাভাবিক। টাকা আমরা পাব না, কিন্তু তুমি টাকা আর প্রাণ দুটোই হারাচ্ছ, লোকসান তোমারই বেশি।
এই শুনে গুণ্ডা খুবই বিচলিত হয়ে সিঁড়িতে বসে পড়ল। সদরের কড়া নাড়ছে প্রতিবেশীরা। কী হল, কী ব্যাপার? প্রভৃতি ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। খুকির জ্ঞান এখনও ফেরেনি।
এখন আর ভাবনা করার সময় নেই। বরং এক কাজ করা যাক, তোমার প্রাণ বাঁচিয়ে দিচ্ছি, টাকার দাবিটা ছেড়ে দাও। মনে রেখো, বেঁচে থাকলে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করতে পারবে। ঠিক বলেছি কি না?
গুণ্ডাটি এইবার ফিক ফিক করে হেসে মাথা হেলাল। সদরে দুম দুম ঘুসি পড়ছে। বউদি ছুটে দরজা খুলেই চিৎকার করে উঠল, সব্বনাশ হয়ে গেছে, শিগগির ডাক্তার ডেকে আনুন। মা মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। ব্লাডপ্রেশার ছিল। রকের কানায় মাথাটা ঠকাস করে লাগল, উফ কীরকম শব্দটা যে হল!
এই বলে বউদি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লাগল। প্রতিবেশীরা ছুটোছুটি শুরু করে দিল। ডাক্তার এল, অ্যাম্বুলেন্সও। মাকে হাসপাতালে পাঠানো হল। খুকির জ্ঞান ফিরে এসেছে, তাকে ঘরে শোয়ানো হল। জনৈক প্রতিবেশীর প্রশ্নের উত্তরে বউদি জানাল, খুকির বিয়ের সম্বন্ধ এক জায়গায় ঠিকঠাক। এইমাত্র জানিয়েছে মেয়ের মাথা খারাপ আছে বলে তারা না কি খবর পেয়েছে। তাই শুনেই মা…
খুকির আচ্ছন্নতা তখনও কাটেনি। ফ্যালফ্যাল চোখে জানলার দিকে তাকিয়ে, সকলের কথাবার্তা তখন তার কানে কম বকমের মতো মনে হতে লাগল।
রাস্তা
দীপু, তাের বাবা এখনও আসছে না যে রে। একবার গেটের কাছে গিয়ে দ্যাখ-না।
মেটারনিটি ওয়ার্ডের গাড়িবারান্দার তলায় তখন একটাই মােটর দাঁড়িয়েছিল। দীপু তার বাম্পারে বসে দেখছিল, উত্তর-পূর্ব কোনার লালবাড়িটার সিঁড়িতে দুটো ছেলে-মেয়ে কথা বলছে। দুজনের হাতেই বুক দেখবার নল। মেয়েটা হেসেই কুটিকুটি। হাসি থামিয়ে সিঁড়িতে উঠছিল। আবার কী শুনে আবার কুটিকুটি। মেয়েটা আটকা পড়ে গেছে। দীপু ভাবল ছেলেটা কি খুব হাসির গল্প জানে, না কি এখনও খিদে পায়নি মেয়েটার!