কালো কাচের চশমাপরা, টেরিলিন ট্রাউজার্স ও জামা গায়ে ছিপছিপে, শ্যামবর্ণ, মোটামুটি সুদর্শন একটা লোক গলির বাঁকটায় দাঁড়িয়ে তার দিকেই যে তাকিয়ে আছে, খুকি প্রথমে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝল, দেহটা কাঁপতে শুরু করল। পাঁচিল থেকে কনুইটা নামাবে সে শক্তিও নেই। লোকটা আস্তে আস্তে বাড়ির সামনে দিয়ে বস্তির দিকে চলে যেতে তখন দেহের উপর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ফিরে পেল খুকি। দুড়দুড়িয়ে সে নীচে নেমে এল।
রাত্রে দালানে এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে কথা চলে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছোবার জন্য।
ভুল দেখেনি খুকি?
না না, আমাদের বাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতেই তো চলে গেল। লুঙ্গি আর। পাঞ্জাবিপরা,নাকটা থ্যাবড়া, কোমরে কিছু-একটা গোঁজা ছিল বলে ওর মনে হল।
ছাদে কি কত্তে দাঁড়িয়ে থাকে অত বড়ো মেয়ে? তোমরা একটু নজরও রাখ না?
আহাহা, দুখানা ঘরের মধ্যে সারাদিন বন্দি থাকবে নাকি? একদিন থাকো না তুমি, বুঝতে
পারবে।
থাক থাক, এখন এই নিয়ে ঝগড়া করে লাভ নেই। সত্যি যদি সেই গুণ্ডাটাই হয় তাহলে কী করা যায় এখন? নিশ্চয় ফেরত নিতেই এসেছে।
পুলিশে ধরিয়ে দিলেই তো হয়।
না না, তাহলে ফাঁসিয়ে দেবে। নিজে যদি বঞ্চিত হয় তাহলে অন্যকেও পেতে দেবে না, এ তো সহজেই বোঝা যায়।
তাহলে ওকে কিছু দিয়ে দিলেই হয়। থলেটা যদি জানলা গলিয়ে না ফেলত তাহলে ধরা পড়তে পারত। তাহলে টাকাও যেত, প্রচুর মা-র খেত আর ফাঁসি তো হতই। এই বাড়িই ওকে বাঁচিয়েছে বলা যায়। এখন ও কোন মুখে দাবি করতে পারে?
কিন্তু গুণ্ডার কি ধর্মবোধ থাকে? দাবি সে করবেই। এর জন্য একটা মানুষ পর্যন্ত খুন করেছে, সেটা ভুলে যেয়ো না। আমাদেরও খুন করতে পারে।
তাহলে দিয়ে দেওয়াই ভালো।
না না, গুণ্ডার দাবির কাছে মাথা নোয়াতে হবে নাকি? আর দেবারই যদি ইচ্ছে হয়, বেশ তাহলে আমাকেই দাও। আমি বোঝাপড়া করে নেব।
তারপর এ বাড়িতে বোমা ফেলুক, রাস্তায় ছুরি মারুক। তোর জন্যে আমরা মরি আর কি?
টাকাগুলো পেলে কালকেই এ বাড়ির ওপর সব দাবি ছেড়ে চলে যাব। তখন তো আর তোমাদের ভয়ের কিছু থাকবে না।
তা হয় কখনো! হঠাৎ বাড়ি ছাড়লে লোকে বলবে কী?
আরে রেখে দাও তোমার লোক। দু-চার দিন বলাবলি করে তারপর সব ভুলে যাবে।
তাহলেও একটা কারণ না দেখালে কি চলে? জিজ্ঞেস করলে কিছু তো একটা আমাদের বলতে হবে।
মিথ্যে বলার কী দরকার, বলে দেবেন বনিবনা হচ্ছিল না। ঝগড়াঝাঁটি নিত্যিই তো লেগে ছিল, তাই আলাদা হয়ে গেল। ক-দিন নয় লোক জানিয়ে গলা ছাড়া যাবে ক্ষণ।
সবই তো বুঝলুম। কিন্তু গুণ্ডা বুঝবে কী করে যে, টাকা তোমরাই নিয়ে যাচ্ছ, আমাদের কাছে নেই?
এ আর এমন কী শক্ত, গোড়াতেই তো আর ছুরি-বোমা মারবে না। যখন দাবি জানাতে আসবে বলে দেবে।
কিন্তু এ বাড়ির ওপর সব স্বত্ব আগে উকিল দিয়ে লেখাপড়া করে ছাড়তে হবে। মুখের কথায় চলবে না।
সকালেই বাবা এবং দাদা উঁকি লের কাছে গেল। তিনি খুব ব্যস্ত ছিলেন, তাই বলে দিলেন সন্ধ্যায় আসতে, খসড়া তৈরি করে দেবেন, পরদিনই রেজিস্ট্রি হবে। তারপর বাড়িতে তুলকালাম একটা ঝগড়া হবে বলেও ঠিক হয়ে রইল।
খুকির ছছাটো দুই ভাই সেই দিনই স্কুল থেকে ফিরে জানাল, মোটামুটি ভালো দেখতে ছিপছিপে ময়লা রঙের একটা লোক রাস্তায় তাদের কাছে খোঁজ নিচ্ছিল, বাড়িতে কে কে
আছে, বাবা-দাদা কখন আসে, জানলায় যে-মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকে তার নাম কী ইত্যাদি। ওদের চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে কাটলেট খাওয়াতে চেয়েছিল, তবে ওরা যায়নি।
শুনেই মা ও বউদির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এল, ছোটো ভাই দুটিকে বিকেলে বেরোতে বারণ করা হল। কিন্তু উপযুক্ত কারণ দর্শাতে না পারায় তারা এই নিষেধাজ্ঞা আগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গেল। কিছু-একটা ঘটবে আশঙ্কা নিয়ে মা ও বউদির মধ্যে বলাবলি হল— ব্যাটাছেলেরা কখন থাকে না-থাকে সেটা জেনে নিচ্ছে।
পইপই বলি অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে আসবে, আড্ডায় জমে যেয়ো না। এখন যদি বাড়িতে দল নিয়ে আসে তাহলে?
আজ উঁকি লের কাছে যাবার কথা আছে না? খুব জোরে চেঁচালেই হয়তো পালিয়ে যাবে। দিনের বেলায় অত সাহস হবে না।
বাঃ, দিনের বেলাতেই তো কান্ডটা ঘটিয়েছিল, সেটা ভুলে যাচ্ছেন কেন? ওদের কাছে কিবা দিন কিবা রাত।
তুমি হাতের কাছে কয়লা ভাঙার লোহাটা বরং রাখো।
এই সময় দুজনেরই মনে হল সদরের কড়াটা বোধ হয় কেউ নাড়ল। একটা সচিত্র সিনেমা পত্রিকা হাতে খুকি ছাদে উঠে রয়েছে। বউদি ছুটে রান্নাঘরে গেল। মা পড়িমরি ছাদে উঠে দেখল খুকি পাঁচিলে হেলান দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। তাকে দেখামাত্র বইটায় মন দিল। কিছু না বলেই মা নেমে এল। বউদি কয়লাভাঙা লোহা হাতে দাঁড়িয়ে।
কেউ না।
কী করে বুঝলেন?
খুকি তো দিব্যি দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছে, নইলে তো ছুটে নেমে আসত সেদিনের মতো।
আমার শরীর যেন কেমন কচ্ছে। সন্ধে হয়ে এল, বাড়িতে একটা ব্যাটাছেলেও নেই।
খুকিকে বরং ডাকি।
এই সময় ওদের মনে হল আবার যেন কড়া নড়ে উঠল।
আলুওলা নয় তো, বলেছিল বিকেলে দাম নিতে আসবে।
তুমি গিয়ে দ্যাখো-না।
আপনি যান-না। খেয়ে তো আর ফেলবে না।
অবশেষে মা গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বার কয়েক কে কে বলে চ্যাঁচাতে আবার খুট খুট কড়া নড়ে উঠল। খিলটা খোলামাত্র হট করে দরজা ঠেলে একটা লোক ভিতরে ঢুকেই বলল, চ্যাঁচাবেন না। দরজায় খিল দিয়ে বলল, আমার থলি আর টাকা নিতে এসেছি। চটপট দিন। চ্যাঁচালে সবাইকেই খুন করে যাব।