না না, এখন কোনো জিনিস হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনো ঠিক নয়। পুলিশ নিশ্চয় নজর রাখছে। তা ছাড়া এই গুণ্ডাটা আগে ধরা পড়ুক তবে তো?
গুণ্ডাটা নিশ্চয় একা নয়, দলও আছে। যদি চড়াও হয়?
দুজন ভীষণ ভাবনায় কথা বন্ধ করে ফেলল। তারপর চান-খাওয়া সেরে যে যার অফিসে চলে গেল। দুপুরে খুকির মা আর বউদি রান্নাঘরে খেতে খেতে বলাবলি করল, দরজা জানলাগুলো ভালো করে বন্ধ আছে কি না শোবার আগে আবার দেখতে হবে।
কড়া নাড়লেই যেন দরজা খুলো না। আগে দেখে নিয়ে তারপর।
তার থেকে যদি দাদার ওখানে রাখা যেত তাহলে এত ভয়ের কিছু থাকত না।
দরকার কী আবার লোক জানাজানি করে।
দাদা সেরকম লোকই নয়। তাহলে আর ব্যাবসা করে খেতে হত না। আমার বিয়েতে চার হাজার টাকা ধার করেছিল, কক্ষনো কারুর কাছে তা ভাঙেনি, এমন চাপা।
তোমার দাদা ছেলে ভালো। খুব নম্র, ভদ্র।
ওই জন্যই তো দাদা খালি লোকসান দিচ্ছে। কত বার ওর বন্ধুরা, এমনকী খদ্দেররা পর্যন্ত বলেছে অত সৎ হলে ব্যাবসা করা চলে না। একদম মিথ্যা বলতে পারে না। অথচ কী ভালো ব্যাবসা। কত মাড়োয়ারি টাকা নিয়ে সাধাসাধি করেছে পার্টনার হবার জন্যে। যদি নেয় তাহলে এখনও হেসেখেলে মাসে পাঁচ হাজার লাভ করতে পারে। কিন্তু ওই…
তা নিলেই তো পারে!
বাঙালি ছাড়া নেবে না, এমন গোঁয়ার যে কী বলব। আপনার ছেলেকে তো বললুম দাদার সঙ্গে নেমে পড়ো। চাকরির সাড়ে চারশো টাকায় ছেলেপুলে নিয়ে কি বাঁচা যায়? হাজার সাত-আট দিলেই…
অত চ্যাঁচাচ্ছ কেন। এখন চারিদিকে লোক ঘুরে বেড়াবে। এক বার একটুখানি শুনতে পেলেই এসে পড়বে। খুকি কোথায়? কী করছে?
খুকি তখন ছাদে। পাঁচিলে কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে এমনিই দাঁড়িয়ে। এক তলা বাড়ির ছাদ, তিন দিক থেকে চাপা। একটুখানি মাত্র গলির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। মায়ের ডাকে খুকি নীচে এসে জানলাবন্ধ ঘরের মেঝেয় শুয়ে পড়ল।
রাতে খুকির বাবা-মা চাপা গলায় আলোচনা করার জন্য বহুদিন পরে আজ পাশাপাশি শুল। দুই ছেলে এবং খুকি আঘোরে ঘুমিয়েছে দেখে তবেই খাট থেকে মা নেমে এসেছে।
এই এক ঝামেলা বাপু ছেলে মেয়ে বড়ো হয়ে গেলে।
আর একটা ঘর থাকলেই হয়।
একটা কেন, দুটো দরকার। খুকির বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। কিন্তু এদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে বউ এনে রাখবে কোথায়?
ছাদে দুটো ঘর অবশ্য তোলা যায়। তবে এদের বিয়ে হতে তো এখনও অনেক দেরি।
ততদিনে পাঁচ টাকার জিনিস পঞ্চাশ টাকায় দাঁড়াবে। এখন করলে তবু ভাড়াটে বসানো যায়। মাস মাস অন্তত একশো টাকা তাহলে আসে।
আমি ভাবছিলুম শ্রীরামপুরে এক বার যাব কি না। ছেলেটার প্রসপেক্ট আছে। দু-বছরের মধ্যেই অফিসার হয়ে যাবে, বংশটাও ভালো।
বড্ড বড়োলোক বাপু এরা, খরচ করতে করতে পরে জেরবার হতে হবে। শুধু বিয়েতে খরচ করলেই তো চলবে না। এই বাড়ির একটা বউ আফিং খেয়েছিল কেন খোঁজ নিয়েছিলে কি? তার থেকে বরং শ্যামপুকুরেরটি ভালো। দোজবরে তো কী হয়েছে। অবস্থাপন্ন, কলকাতায় নিজের বাড়ি, খাঁইও একদম নেই। আমার যা গয়না আছে তাই ভাঙিয়েই হয়ে যাবে।
লোকটার বয়স খুকির দু-গুণ। দুটো ছেলেও আছে।
আছে তো কী হয়েছে? খুকির অত বাছবিচার নেই, যা দেবে আমার সোনামুখ করে নেবে।
পাশের ঘরে খুকির দাদা-বউদি প্রথামতো দাম্পত্য-ক্রিয়া সেরে চিত হয়ে বিশ্রাম করছে। একটা আরশোলা ফরফর করে উড়তে শুরু করল। দুজনে তখন খুব বিরক্ত হয়ে বলতে লাগল, এঁদো ঘরে মানুষ থাকতে পারে?
নোনা লেগে ইটগুলো পর্যন্ত ক্ষয়ে গেছে।
এর থেকে নতুন বাড়িতে ভাড়া থাকাও ভালো।
এরপর তো ঘরে কুলোবে না, তখন কী হবে?
বেরোতে হলে এখনই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু বাড়িভাড়া টানার মতো রোজগার না হলে আলাদা থেকে সংসার চালানো যে কী অসম্ভব ব্যাপার…
আজ বলেছিলুম দাদার সঙ্গে ব্যাবসায় নামার কথাটা। একদম গা করল না। মনে হয় কোনো মতলব আছে ওঁদের।
যে-মতলবই থাক, খরচ করতে গেলেই নজরে পড়বে। তখন ক্যাঁক করে পুলিশ ধরবে, পেলে কোথায়? কী জবাব দেবে তখন? অবস্থা তো সবাই জানে। বাসনমাজার ঝি তো আমার বিয়ের পর রাখা হল।
বুঝিয়ে বলো-না। ড্রামের মধ্যে রেখে তো কোনো লাভ নেই। বরং নিজেদের লোকের সঙ্গে ব্যাবসায় খাটালে কিছু আসবে। মিনমিন করলে কি চলে! এখন নয় একটা ছেলে, তারপর আরও তো হবে, বাবা-মা আর কদ্দিন!
বলার সুযোগ যে পাচ্ছি না!
পরদিন অফিস যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুকির দাদা মোড়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে বাবাও অফিসে বেরোল। দুজনে দেখা হতেই কথা শুরু হল –
কাল বড়োশালার সঙ্গে দেখা হল। ব্যাবসাটাকে বড়ো করতে চায়। কিছু টাকা দিয়ে যদি পার্টনার হওয়া যায়—তুমি কী বল?
ভালোই তো, কিন্তু টাকা পাবি কোথায়?
ড্রামের মধ্যে না পচিয়ে কাজে লাগাতে তো হবে।
খুকির বিয়ে দিতে হবে। আবার তোর মা বলছে ছাদে দুটো ঘর তুলতে।
ভালোই তো। কিন্তু খরচ করতে দেখলেই তো কথা হবে হঠাৎ এত টাকা এল কোত্থেকে?
তা বটে। আচ্ছা ভেবে দেখি।
ভেবে দেখতে গিয়ে এক সপ্তাহ কেটে গেল। তার মধ্যে খুকির মা ও বউদির কথা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। বাবা ও দাদা অফিস যাবার সময় ট্রামস্টপে প্রতিদিনই তর্ক করে যাচ্ছে। সংসারখরচের টাকা যেভাবে খরচ হওয়া উচিত তা হচ্ছে না, এই যুক্তিতে দাদা চিৎকার করে মা-র সঙ্গে ঝগড়া করল পর পর তিন দিন। দুটো ঘর থেকেই ভাঁড়ারের দরজা দেখা যায়। দুই ঘর থেকে পালা করে সারারাত ভাঁড়ার ঘরের দিকে সন্দেহকুটিল চোখ পাহারা দিতে শুরু করেছে। আর খুকি, দুপুরে ঘরে জানলা বন্ধ থাকে, তাই ছাদে উঠে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চড়াই বা পায়রা দেখলে শুধু নাকের পাটা ফুলোয়।