যদি এবারও ফসকায়? দূরে অধৈর্যভাবে হর্ন বাজল।
এবার যদি ফসকায়, তাহলে বৃদ্ধ চুরমার হয়ে যাবে। বরং থাক, ওর হেড করা দেখে কোনো লাভ নেই। চন্দন বলটা মাটিতে ফেলে দিল।
কী হল?
না। আমার সময় নেই, ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে।
শুধু এক বার, এই শেষ!
চন্দন হাঁটতে শুরু করেছে। ওর পিছনে পিছনে আসছে শিবকৃষ্ণন।
কতটুকু সময় আর লাগবে, এক বার…হেড করতে পারি কি না-পারি দেখাব। কলকাতায় গিয়ে আপনি বলবেন, শিবের হেডিং দেখেছি, হ্যাঁ ষাট বছরের শিবের…একটুখানি, এক মিনিটও লাগবে না…
চন্দন হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিল। বৃদ্ধ ওর সঙ্গে তাল রেখে চলতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বোম্বাই রোডে পা দিয়ে চন্দন এক বার তাকায়। বিরাট মাঠ, বিরাট বট গাছের পটভূমিতে জীবনের কিনারায় পৌঁছোনো ক্ষীণ চেহারার একটা মানুষকে সে দেখতে পেল।
একটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটতে গিয়েও ঘটল না। চন্দন তখনই ঠিক করল, জ্যোতিষীর কথামতো কালই মুক্তোর আংটি গড়াতে দেবে।
যুক্তফ্রন্ট
তখন ভরদুপুর। খুকি দু-হাতে জানলার গরাদ ধরে, শরীরকে আলগা করে দাঁড়িয়ে। গলিটা খুব সরু। এঁকেবেঁকে একদিকে বড়ো রাস্তায় অন্য দিকে একটা বস্তির মধ্যে পড়েছে। জানলার সামনেই একটা কারখানাবাড়ির টিনের দেয়াল। বস্তুত জানলায় দাঁড়িয়ে খুকি কিছুই দেখতে পায় না যদি না কোনো লোক জানলার সামনে দিয়ে যায়। বস্তির লোকই বেশিরভাগ সময় যাতায়াত করে। তাদের দেখতে খুকির ভালো লাগে না। খুকির স্বাস্থ্য ভালো। দেখতেও মন্দ নয়। পাত্র দেখা হচ্ছে।
মেঝেয় আদুড় গায়ে ওর মা ঘুমোচ্ছে, পাশের ঘরে বউদি বাচ্চা নিয়ে। দুই ছোটোভাই স্কুলে গেছে। বাবা আর দাদা অফিসে। আশেপাশে সমবয়সি মেয়ে নেই যে খুকি দু-দন্ড ঘুরে আসবে। সামনের টিনের দেয়ালে একটা পোস্টারে লেখা–সাম্রাজ্যবাদকে খতম করতে হলে শোধনবাদের সঙ্গে লড়াই করুন। খুকি দেখল গত পনেরো দিনে খতম করতেটা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। করুনটা ছেঁড়া। এ ছাড়া গলিতে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। একটা সিনেমা পোস্টারও ঢোকে না এমন হতভাগা গলি।
বড়ো রাস্তার দিকে পটকা ফাটার শব্দ হল দুটো। কিছু হইচই শোনা গেল। ওরকম হরদমই শোনা যায়। খুকির তখন কারখানাবাড়ির চালায় চোখ। দুটো পায়রা, নিশ্চয়ই মদ্দা এবং মাদি, বকম-বকম করতে করতে যা করার তাই শুরু করে দিয়েছে। খুকি প্রথমেই পিছনে তাকিয়ে ঘুমন্ত মাকে দেখে নিল। অতঃপর নিশ্চিন্ত হয়ে, গভীর মনোযোগে যখন মুখটি উপরে তুলে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল তখন সে শুনতে পেল না গলি দিয়ে ছুটে আসা পায়ের শব্দ।
তাই বিষম চমকে গেল লোকটিকে একেবারে তার দু-হাতের মধ্যে দেখে। হাতে ক্যাম্বিসের ব্যাগ। ব্যাগটা জানলা গলিয়ে খুকির পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে, এটা রাখুন তো, পরে নিয়ে যাব। বলেই ছুটে চলে গেল।
খুকির তখন রা কাড়ার ক্ষমতা নেই। নড়াচড়ারও। ফ্যালফ্যাল করে সে ব্যাগটার দিকে শুধু তাকিয়ে। অনেকগুলো পায়ের শব্দ আর ডাকাত ডাকাত, পাকড়ো পাকড়ো চিৎকার গলি দিয়ে এগিয়ে আসছে। ভয় পেয়ে খুকি জানলা বন্ধ করে দিল। শুনতে পেল ছুটন্ত লোকগুলো বলছে, ব্যাঙ্কের সামনেই—গাড়িতে ওঠার সময় লুট করেছে। একটা ধরা পড়েছে। অবশেষে পায়রাদের কান্ড এবং এই ব্যাগ, দুয়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে খুকি। মাকে ডেকে তুলল।
মাঝরাতে বাবা-মা দাদা-বউদি ঘরের দরজা-জানলা এঁটে গুনে দেখল দশটি বাণ্ডিলে মোট দশ হাজার টাকা। সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
ঠিক কী বলেছিল লোকটা, আবার আসব? দাদা ফিসফিস করে বলল।
ওকে দেখলে আর চিনতে পারবে কি? মনে তো হয় না। ফিসফিস করে মা বলল।
তাতে কী আসে-যায়, বাড়িটা তো চিনবে। বউদি চাপা সুরে বলল।
লোকটা ধরা পড়েছে কি না আগে সেই খোঁজ নিতে হবে। বাবা দমবন্ধ করে বলল।
ব্যাগটা এখন কোথায় রাখা হবে?
আমার খাটের তলায় থাক। বউদি পরামর্শ দিল।
ইঁদুর আরশোলার উৎপাত বড়ো। কেটে দেবে। বরং ঠাকুরঘরে থাক। মা প্রতিবাদ করল। রাখা সম্পর্কে কোনো ঐকমত্য না হওয়ায় স্থির হল ভাঁড়ারে আটা রাখার ড্রামে ব্যাগটা ভরে ঢাকনাটা কষে এটে দেওয়া হোক। যদি পুলিশ সার্চ করতে আসে আগেই তো সিন্দুক তোরঙ্গ দেখবে। আটার ড্রাম অনেক নিরাপদ।
পরদিন সকালেই দাদা এবং বাবা খবরের কাগজে হুমড়ি খেয়ে বৃত্তান্তটা খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেল। মাইনে দেবার জন্য দশ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এক কারখানার ক্যাশিয়ার গাড়িতে উঠছিল। তখন দুজন দূবৃত্ত বোমা ছুড়ে টাকার থলি ছিনিয়ে চম্পট দেয়। একজন ধরা পড়েছে, থলি নিয়ে অন্যজন পালিয়ে গেছে। ক্যাশিয়ার হাসপাতালের পথেই মারা যায়।
তখন ফিসফিস করে দুজনে বলাবলি করল
আর কেউ জানে বলে তো মনে হচ্ছে না।
কী করে জানবে? ছুটতে ছুটতে গলিতে ঢুকে বোধ হয় ভয় পেয়েই থলিটা তাড়াতাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেছে। আনাড়ি মনে হচ্ছে।
নিশ্চয় নিতে আসবে।
আসুক-না, দেখা যাবে ক্ষণ।
যদি ধরা পড়ে তাহলে ভালোই হয়।
মারের চোটে কোথায় থলিটা রয়েছে পুলিশের কাছে তা ফাঁস করেও তো দিতে পারে?
তা বটে। ধরা না পড়াই ভালো।
অবশ্য বলা যায়, থলির কথা আমরা কিছুই জানি না।
তাহলেও পুলিশ সার্চ করতে আসবেই। গুণ্ডাটাকে যখন ভদ্রলোকের মতোই দেখতে, অবশ্য খুকির মতে, তখন পুলিশ কোনো ওজর আপত্তিই শুনবে না। বহু ভদ্রলোকই তো এসব কাজ করে।
তাহলে থলিটা বাড়িতে রাখা ঠিক হবে না। আমার শালার কাছে বরং…