ছেলেটি পিঠে ধাক্কা দিতেই চিত হয়ে মুখ ফেরাল।
আমি কলকাতা থেকে এসেছি। গাড়িটা খারাপ হয়ে বন্ধ হতে চা খাবার জন্য দোকানে বসি। ছবিটা দেখে ভাবলুম দেখেই যাই মানুষটাকে, এত গল্প শুনেছি আপনার সম্পর্কে।
শিব উঠে বসল। ছবির লোকটির সঙ্গে চেহারার কোনো মিল নেই। কাঁচা পাকা দাড়ি গোঁফে গালের গর্ত ঢাকা, হাত দুটো লাঠির মতো সরু, বুকের প্রায় সব পাঁজরই গোনা যায়। শুধু মাথাটার আকৃতি থেকে অনুমান করা যায় এই লোকই শিবকৃষ্ণন। দেহের সঙ্গে বেমানান আকারের বেঢপ মাথাটা, কপাল মাত্রাতিরিক্ত চওড়া। অথচ হেডিং নাকি খুবই বাজে ছিল।
আমার বিষয়ে গল্পই শুনেছেন, নিশ্চয় খেলা দেখেননি। বয়স কত?
দুর্বল কণ্ঠস্বর। প্রায় চল্লিশ বছর বাংলায় বাস করে নিখুঁত বাংলা উচ্চারণ।
না, দেখিনি, ওই ছবিটা যখনকার তখনও আমি জন্মাইনি। আপনার কী অসুখ? সিরিয়াস কিছু কি?
না না, অসুখটসুখ কিছু নেই। এরকম শরীর খারাপ ফুটবলারদের তো হয়ই, বল নিয়ে
আধঘণ্টা মাঠ এধার-ওধার করলেই ঠিক হয়ে যায়।
আপনি কি এখনও মাঠে নামেন না কি?
চন্দন অবাক হবে কি-না বুঝতে পারছে না। এই শরীর, এই বয়স-বলে কী!
মাঠে নামব যে, মাঠ কোথায়, বল কোথায়? একটু হেসে বলল, বয়স কোথায়, হেলথ কোথায়? আসলে আমার মনে হয়, ফুটবলারের শরীরের অসুখ সারাতে পারে শুধু খেলে, বল খেলে। দাঁড়িয়ে কেন বসুন বসুন।
তক্তার তলা থেকে ছেলেটা একটা রবারের বল বার করে পা দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। দূর থেকে ওর মায়ের চিৎকার শুনেই বলটা ফেলে রেখে ছুটে বেরিয়ে গেল।
বউ আমার বাঙালি, এখানকারই মেয়ে। কলকাতার হোটেলে কাজ করত, আমিও করতুম, তখন পরিচয় হয়। আমার জন্য অনেক করেছে, এখনও করে।
আপনার এই অবস্থা—ফুটবলারদের সাহায্য-টাহায্য, পেনশন এসব তো দেওয়া হচ্ছে, অ্যাপ্লাই করুন-না।
যেভাবে তাকিয়ে আছে, চন্দনের মনে হল না তাতে অভিমান রয়েছে। অথচ বুড়োরাই তো বেশি অভিমানী হয়।
টাকার তো সবসময়ই দরকার।
আমি তাহলে ফুটবল খেললাম কেন, অন্য কিছু করে টাকা রোজগার করতে পারতাম তো। খেলে তো টাকা পেতাম না।
চন্দন অস্বস্তি বোধ করল। সত্যিই তো, তারা কীসের জন্য খেলত। হাততালির জন্য। এইটুকু ছাড়া আর কী?
আপনি কোনো খেলাটেলা করেন?
চন্দন বলতে যাচ্ছিল, আপনার ক্লাবেই এখনও আমি স্টার গণ্য হই। কিন্তু বলতে গিয়ে গলাটা কে যেন চেপে ধরল। কোনোক্রমে বলল, একটুআধটু ফুটবলই।
অ।
শরীরে রোগ নেই, আর্থিক কষ্ট নেই, ভালোই আছি। চন্দনের মনে হল এই বুড়োটা একটু যেন হামবড়া ধরনের।
আপনি খেলাটেলা দেখেন?
বছর পাঁচেক আগে খড়গপুরে একটা ম্যাচ দেখেছি, তাও ষোলো বছর বাদে।
পাঁচ বছর আগে চন্দন খঙ্গপুরে একটা এগজিবিশন ম্যাচ খেলে গেছে। দেড়শো টাকা নিয়েছিল। সেই ম্যাচটাই কি?
কী মনে হল, এখনকার প্লেয়ারদের।
চুপ করে রইল।
আপনাদের সময়ে আর এখনকার সময়ের খেলায় অনেক বদল হয়ে গেছে।
কিন্তু স্কিল, সেন্স, শুটিং এসব?
এবার চন্দন চুপ করে রইল।
আমার খালি রসিদের, সোমানার, মেওয়ার, আমার কথা মনে পড়ছিল।
এবার চন্দন আড়চোখে ঘড়ি দেখল। প্রায় দু-ঘণ্টা কেটেছে, ত্রিপিতের ফেরার সময় হল। দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করবে। কাল ম্যাচ পোর্টের সঙ্গে। ইজি ব্যাপার, তাহলেও তাড়াতাড়ি ফিরে রেস্ট নিতে হবে। তিনটে দিন খুবই ধকলে কেটেছে।
যেসব গোল মিস করছিল…
হঠাৎ চন্দনের ইচ্ছে হল এই লোকটিকে কষ্ট দিতে। এই নাক-সিটকানো ভাবটা সে অনেক দেখেছে। ঈর্ষা ছাড়া আর কিছু নয়।
জানেন কি এখন ফুটবলাররা কেমন টাকা পায়?
না, কাগজ পড়তে পারি না, লেখাপড়া করিনি।
চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট হাজারও।
আমি এক বার দুশো টাকা পেয়েছি মোহনবাগানকে গোল দিয়ে। বকাইবাবু দিয়েছিল খুশি। হয়ে। কমল ওইরকম বল না দিলে গোলটা পেতাম না। ওকে একশো দিয়েছিলাম।
এখনকার অনেক প্লেয়ারেরই গাড়ি আছে, অনেকেই বাড়ি করেছে, দোকান ব্যাবসা কেঁদেছে, হাজার হাজার টাকা জমিয়েছে।
কথাগুলো যেন ওর কানে ঢুকল না। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের কোনো একটা দিনে ফিরে গিয়ে ও বোধ হয় সেই গোলটা দেখতে পাচ্ছে। মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
আমার হেডিং নাকি খারাপ, অথচ গোলটা পেয়েছিলাম হেড করে। বাজে কথা রটানো হয়েছিল আমার সম্পর্কে। জীবনে অনেক গোলই আমি হেড করে দিয়েছি।
তক্তাপোশ থেকে নেমে রবারের বলটা কুড়িয়ে নিয়ে চন্দনকে দিল। হাত ধরে ওকে ঘরের বাইরে আনল।
এটা ছুড়ুন। আপনাকে দেখাচ্ছি কীভাবে গোলটা করেছি, ছুড়ুন।
চন্দন বিব্রত হয়ে, কিছুটা মজাও পেয়ে বলটা আলতো করে ওর মাথার উপর তুলে দিল। হাত মুঠো করে, অল্প কুঁজো হয়ে ও তৈরি।
বলটা ওর কাঁধের উপর পড়ল। ফসকে গেছে। চন্দন কুড়িয়ে নিয়ে এবার আরও আলতো আরও উঁচু করে তুলে দিল।
মুখ তুলে অপেক্ষা করছে শিবকৃষ্ণন। বলটা যখন মাথার কাছাকাছি তখন বাঁ ধারে হেড করার জন্য মাথা ঝাঁকাল। ওর থুতনির উপর পড়ল।
অপ্রতিভ হয়ে শিবকৃষ্ণন বলটার দিকে তাকিয়ে রইল মুখ নীচু করে।
আবার দিন।
চন্দন আর তিন বার বল শুন্যে ছুড়ল। তিন বারই ও ফসকাল।
থাক!
না না, আমি পারব, আপনি আবার ছুড়ুন।
দূর থেকে পর পর দু-বার মোটরের হর্ন ভেসে এল। ত্রিপিত নিশ্চয়।
থাক আপনার শরীর খারাপ।
আর এক বার, শুধু এক বার।
বৃদ্ধ যেন ভিক্ষা চাইছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হল চন্দনের।
এই শেষ বার।
শিবকৃষ্ণন অপেক্ষা করছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়, ঘাড় এবং বাহুরশিরাগুলো ফুলে উঠেছে। উজ্জ্বল ঝকঝকে রোদ। পিছনে শাখাপ্রশাখা মেলা বিরাট এক বট গাছ। তার পিছনে বিস্তৃত খেত। কচি ধানের চারা। লাঙল দিচ্ছে চাষি। ডান দিকে একটা ডোবা। কলা গাছ। দূর থেকে ভেসে এল ইলেকট্রিক ট্রেনের ভেঁপু। এইসবের মধ্যে এককালের ফুটবলার, প্রায় অসমর্থ, পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের যৌবনে ফিরে যাবার জন্য জেদ ধরে দাঁড়িয়ে। জীবনে শেষ বারের মতো ও একটা হেডিং দেখাতে চায়।