স্ত্রীলোকটি চা তৈরি করতে করতে মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখল। প্রায় উলঙ্গ লোকটি পিটপিট করে তাকিয়ে। বেঞ্চে-বসা লোক দুটি উঠেছে, বোধহয় বাস আসছে।
মলিন কাচের পিছনে, চন্দন ক্রমশ বুঝতে পারল, একটা ফুটবল টিম। আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে সে যা আবিষ্কার করল, তাতে চমকে ওঠারই কথা। আইএফএ-র সাতচল্লিশ সালের টিম, যা বর্মা, সিঙ্গাপুর সফর করেছিল।
এ ছবি এখানে কে টাঙাল।
চন্দন স্ত্রীলোকটিকে লক্ষ করেই বলল।
ওর বাবা।
ছেলেটিকে মুখ তুলে দেখিয়ে দিল। ওর মুখের ভঙ্গির মতো কণ্ঠস্বরও কর্কশ।
ছবিটা যুগের যাত্রীর টেন্টেও টাঙানো আছে। যাত্রীর চার জন এই টিমে ছিল। তাদেরনামগুলো চন্দন জানে।
খুব বুঝি ফুটবল ভালোবাসে?
জবাব এল না। স্ত্রীলোকটির বদলে ছেলেটি বলল, বাবার ছবি আছে ওটায়।
ভাঁড়ে না গেলাসে?
স্ত্রীলোকটি বিরক্ত মুখে তাকিয়ে।
ভাঁড়ে।
চন্দন কৌতূহলভরে এবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় তোমার বাবা?
ও এগিয়ে এসে মাটিতে বসা চার জনের মধ্যে একজনের মুখে আঙুল রাখল।
শিবকৃষ্ণন।
চন্দন ফ্যালফ্যাল করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থেকে আবার ছবির দিকে মুখ ফেরাল।
যুগের যাত্রীরই শিবকৃষ্ণন। ডাকসাইটে লেফট-ইন। ওর আমলে সব থেকে পপুলার প্লেয়ার। হায়দরাবাদের কোনো এক গ্রাম থেকে বাচ্চা বয়সে কলকাতায় এসে কালীঘাট স্পোর্টিং ইউনিয়ন ঘুরে দু-বছর ইস্টবেঙ্গলে খেলে যুগের যাত্রীতে আসে। যখন ও খেলা ছাড়ে তখন চন্দনের বয়স বছর চারেক। প্রবীণরা যখন পুরোনো আমলের কথা বলে, তখন শিবকৃষ্ণনের নাম অবধারিত ভাবেই ওঠে।
থ্রু পাস দেবার নাকি মাস্টার ছিল। ধীর শান্তভাবে খেলত। হেডিং বা শুটিং তেমন ছিল না। খালিপায়েই খেলে গেছে। পায়ে আঠার মতো বল লাগিয়ে রাখত, জনা তিনেককে অবহেলায় কাটাতে পারত। শিবের মতো ইনসাইড আজ কলকাতার মাঠে নেই। এখন সামনে প্লেয়ার পড়লে কাটিয়ে বেরোতে ক-জন পারে? মনে আছে, কেওএসবি-র হেণ্ডারসনকে ছ-বার কী রকম কাটিয়েছিল।
সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। শিবের বল হোল্ড করে রাখা নাকি দেখার ছিল। নষ্ট হল নেশা করে। গাঁজা, চরস কিছুই বাদ ছিল না। এখনকার মতো পয়সা তো সে-আমলে পেত না। তবু বিশ-পঁচিশ যা পেত উড়িয়ে দিত। আহা, কী বল ছাড়ত।
সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। শিবের গল্প অনেক বার চন্দন শুনেছে। প্রথম দিকে বিস্মিত হত, পরের দিকে বিরক্ত। বুড়োদের কাছে যা ভালো, সবই পুরোনো আমলের। তখন নাকি প্লেয়াররা আদা ছোলা চিবিয়ে ক্লাবের জন্য জান দিত, টাকা পাওয়ার চিন্তাই করতে পারত না, তখনকার প্লেয়াররা নাকি ভদ্রতার বিনয়ে মাখনের মতো ছিল। আজ যে যুগের যাত্রী দেখছ, এত টাকা, এত ট্রফি, এসবের শুরু ওই আমল থেকে। ওরাই ক্লাবকে প্রথম সাসসেস এনে দেয়, রোভার্সে, ডুরাণ্ডে ফাইনালে সেমি-ফাইনালে ক্লাবকে তোলে, যাত্রীকে পপুলার করে, অল ইণ্ডিয়া নাম হয়।
সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। এসব কথা চন্দন মানে। বহু জায়গায় বক্তৃতায় সে ছটোদের উপদেশও দিয়েছে-বড়োদের শ্রদ্ধা করবে, অতীতকে ভুলবে না। নিজেও সে অতীতের নামি ফুটবলার দেখলেই প্রণাম করে পায়ে হাত দিয়ে। তারপর দেখে চারপাশের লোক সপ্রশংস চোখে তার দিকে তাকিয়ে, তখন নিজেকে খানিকটা লম্বা মনে হয়।
শিবকৃষ্ণন তোমার বাবা?
চন্দনের কণ্ঠে পরিষ্কার অবিশ্বাস। ছেলেটি লাজুক চোখে স্ত্রীলোকটির দিকে তাকায়।
হ্যাঁ। ভাঁড়টা এগিয়ে ধরে বলল।
চন্দন সেটা নিয়ে বলল, আপনি?
বউ।
উনিই তো যুগের যাত্রীর শিবকৃষ্ণন?
কী জানি।
কী জানি।
চন্দনের বিস্মিত প্রতিধ্বনিতে ভ্রূ কুঁচকে স্ত্রীলোকটি তাকাল।
উনি তো ফুটবল খেলতেন?
হবে। আমি ওসব কিছু জানি না!
উনি কোথায়?
ঘরে।
কিছু করছেন কি, মানে ব্যস্ত? দেখা হতে পারে?
করবে আবার কী, যা করার সে তো আমিই করি। দিনরাত তো বিছানাতেই পড়ে থাকে।
কিছু হয়েছে কি ওঁর?
মাথার যন্ত্রণা, হাঁটুতে ব্যথা, বুকে হাঁপানি, সর্দি কাশি—আপনি কি ওর চেনা? হাসপাতালে ভরতি করিয়ে দিতে পারেন?
চেষ্টা করতে পারি।
শিবকৃষ্ণনের বউ চন্দনের মুখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে ছেলেকে বলল, আমি এখন দোকান ছেড়ে যেতে পারব না, তুই সঙ্গে করে নিয়ে যা।
ছেলেটির সঙ্গে চন্দন কয়েক পা এগোতেই ডাক পড়ল, চায়ের পয়সাটা দিয়ে যান।
দাম চুকিয়ে সে রওনা হল, গাড়িটা খারাপ হওয়া এখন তার কাছে শাপে বর মনে হচ্ছে। কলকাতায় ফিরে সবাইকে চমকে দেবে।
শিবকৃষ্ণনকে সে খুঁজে বার করেছে, কথা বলেছে। সবাই তো ধরেই নিয়েছে, ও মারা
গেছে।
জ্যান্ত শিবকৃষ্ণনকে দেখে আসার গল্প করলে সবার আগে দৌড়ে আসবে তো খবরের কাগজের, ম্যাগাজিনের লোকেরা।
অল্প দূরেই ছোট্ট একটা কুঁড়ে। একখানিই ঘর। দরজায় দাঁড়িয়ে চন্দন ভিতরে তাকাল। দেয়ালে এক হাত গর্ত, এটাই ঘরের জানালা। ওর মনে হল নীচু তাপপাশে একটা লোক শুয়ে। ঘরে আসবাব কিছুই নেই। গোটা দুই অ্যালুমিনিয়াম থালা আর একটা মগ মেঝেয় উপুড় করা। একটা মাটির হাঁড়ি, জলের কলসি, আর কয়েকটা শিশি। তক্তাপপাশের নীচে টিনের সুটকেস, এক জোড়া পুরোনো চটি। দেয়ালে দড়িতে ঝুলছে কাপড়চোপড়। কুলঙ্গিতে কয়েকটা কৌটো আর বিঘতখানেকের আয়না।
লোকটি অর্থাৎ শিবকৃষ্ণন, যে কলকাতা বা ভারতের ফুটবল মাঠে সাতাশ বছর আগে শিব নামে খ্যাত ছিল—পাশ ফিরে শুয়ে। পরনে জীর্ণ লুঙ্গি মাত্র।