আর্থিক সাফল্য অবশ্যই চন্দন পেয়েছে। কোনোক্রমে স্কুল ফাইনাল পাস। ক্লাবই ব্যাঙ্কে চাকরি করে দিয়েছে। এখন পাচ্ছে প্রায় আঠারোশো। জ্যোতিষী বলেছিল গোমেদ আর পোখরাজ ধারণ করতে, করেছে। চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার তার দর উঠেছিল। সে বছরই। এখন সে ফ্লাটের মালিক, বেনামিতে একটি ওষুধের দোকান করেছে, পঞ্চাশ হাজার টাকা খাটছে সুদে এবং সম্প্রতি এই গাড়িটি।
জ্যোতিষী বলেছিল, সুন্দরী বউ পাবে, বতু অর্থাৎ ব্রততী প্রকৃত সুন্দরীই। চন্দনের ভক্ত এক ফিলম ডিরেক্টর ব্রততীর জন্য কিছুদিন ধরনাও দিয়েছিল। ফিলমে নামাটা চন্দনের পছন্দ নয়। বতু তাকে ভালোবাসে এবং সে বতুকে। বতু চায় চন্দন স্মার্ট লোকদের মতো নিজেই গাড়ি চালাক। কিন্তু জ্যোতিষী বলেছিল ত্রিশ বছরের পর ফাঁড়া আছে, একটা মুক্তো ধারণ করলে হয়। তখন বয়স ছিল সাতাশ। ত্রিশ হোক তো, এই ভেবে মুক্তো আর ধারণ করা হয়নি, আজও হয়নি।
গাড়িটা কিনেই তার মনে পড়েছিল ফাঁড়ার কথাটা। শরীর ছমছম করে উঠেছিল। গোল এরিয়ার হিংস্রতম ডিফেণ্ডারদের মোকাবিলায় যে কখনো ভয় পায়নি সেই চন্দন মিত্র গোপনে ভয় পায় অ্যাকসিডেন্টকে। হাত-পা বিচ্ছিন্ন ধড়, গুঁড়িয়ে-যাওয়া পাঁজর, তালগোল পাকিয়ে চটকানো দেহ—নিজের এইরকম একটা চেহারা যখনই তার চোখে ভেসে ওঠে তখন কিছুক্ষণের জন্য সে বিমর্ষ বোধ করে। গাড়িতে দিঘা রওনা হবার সময় ড্রাইভার ত্রিপিত সিংকে বার বার নির্দেশ দিয়েছিল—ত্রিশ মাইলের বেশি জোরে যাবে না, অন্য গাড়ির সঙ্গে রেস দেবে না, ওভারটেক করবে না, ট্রাক-বাস-লরি সামনে পড়লেই বাঁয়ে সরে যাবে।
এইসব বলার পর তার মনে হয়েছিল বয়সটা বোধ হয় সত্যিই বেড়েছে। খেলার দিন যে ফুরিয়ে আসছে, তা তো এবারই বোঝা গেল। তন্ময়, বাসব, প্রদীপকে ট্রান্সফারের দশ দিন। আগে তুলে রেখেছিল, কিন্তু তাকে ছেড়ে রাখে। এক ধাক্কায় দশ হাজার টাকা এবার কমে গেছে।
বোম্বাই রোডের উপর অচল গাড়িটার দিকে তাকিয়ে চন্দন ভাবল, বয়স বাড়ছে। দু-এক বছরের মধ্যেই টিম তাকে খারিজ করে দেবেই। আয় কমে যাবে। গাড়িটা কেনার কি কোনো দরকার ছিল? দশ বছর আগেও তো ট্রাম আর বাস ছিল তার সম্বল। তারও আগে আধপেটা দিন আর এখানে-ওখানে খেপ খেলা।
ত্রিপিত সিং খগপুরে ফিরে গেছে ডিস্ট্রিবিউটর বক্সটা সঙ্গে নিয়ে। গোলমাল ওটাতেই ঘটেছে। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে চন্দন খড়ঙ্গপুরগামী একটা ট্রাককে হাত তুলে থামতে বলেছিল। অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে যায়। তার পিছনে একটা প্রাইভেট মোটর ছিল। আপনা থেকেই সেটা থামে। দরজা খুলে দিয়ে পিছনে বসা লোকটি বলেছিল, আসুন।
চন্দন ঈষৎ গর্ব বোধ করেছিল। কিন্তু ত্রিপিত ছাড়া ব্যাপারটা দেখার জন্য আর কেউ ছিল। গত বছরও দুটো পত্রিকা তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছে। লিগ এখন মাঝামাঝি, ইতিমধ্যে তিন বার তার ছবি বেরিয়েছে। কয়েক লক্ষ লোক তার মুখ চেনে। শুধুমাত্র তাকে দেখেই গাড়ি থামে, এখনও থামে— দর পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও। বাঙালিরা সত্যিই ফুটবল ভালোবাসে।
ওই গাড়িতে ত্রিপিত গেছে খঙ্গপুর। ফিরতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। মনে হয়, ঘণ্টা দুই। গাড়ি পাহারা দেবার জন্য চন্দন রয়ে গেল। কিছুক্ষণ গাড়ির মধ্যে বসে থাকার পর বিরক্ত হয়ে নেমে, দরজা লক করে সে পায়চারি শুরু করল।
রাস্তাটা এখানে–পাশাপাশি ছটা লরি যেতে পারে, এমন চওড়া। দু-ধারেই খেত, পাটের আর ধানের। প্রচন্ড গরমের পর বৃষ্টি হয়ে গেছে দু-সপ্তাহ আগে। কাল রাতেও হয়েছে। দূরে জমিতে লাঙল দিচ্ছে এক চাষি। চন্দন অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে চায়ের জন্য তৃষ্ণা বোধ করল।
বোম্বাই রোড থেকে সরু সরু মাটির পথ বেরিয়ে গ্রামের দিকে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে সে ওইরকম এক পথের মুখে এসে পড়ল। কয়েকটা চালাঘরের দোকান। তার পাশে পাঁচিল ঘেরা এক কারখানা। গোটা তিনেক এক তলা কোয়াটার্স। একটা গ্রামেরও আভাস পাওয়া যায় গাছপালার আড়ালে।
কামারের দোকানের পাশে সাইকেল সারাইয়ের দোকান, তার পরেরটি চায়ের। দোকানের বাইরে বাঁশের বেঞ্চে দুটি লোক বসেছিল সুটকেস আর থলি নিয়ে। বোধ হয় এখানে বাস থামে। চন্দন তাদের পাশে বসল। হাতঘড়িতে সময় দেখল সাড়ে দশটা।
দোকানটির শীর্ণ এবং জীর্ণ দশার মতো দোকানিটিও। শাড়িটার রং একদা লাল ছিল বোঝা যায়। যেমন বোঝা যায় ওর গায়ের রং একদা গৌর ছিল। হয়তো দেহেও লাবণ্য ছিল এবং তারুণ্যও। এখন দু-চোখে খিটখিটে উত্তাপ এবং পাড়ুর মুখ। একটি বছর দশ বয়সের ছেলে কয়লা ভাঙছে।
চা হবে?
চন্দন গলাটা চড়িয়েই বলল।
হবে।
বিস্কুট, চানাচুর, কেক ছাড়াও পাঊরুটি এবং বাতাসাও আছে। পান, বিড়ি, সিগারেটও একপাশে। সব কিছুই কমদামি, দেখে মনে হয় এদের অনেকগুলিই দীর্ঘকাল পড়ে রয়েছে।
এই মেয়েটি বা বউটিই তাহলে মালিক। এই তো দোকানের অবস্থা, চলে কী করে? স্বামী হয়তো কোথাও কাজটাজ করে। এইসব ভাবতে ভাবতে চন্দন চারধারে চোখ বুলিয়ে, মেদিনীপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে যথেষ্ট রকমের মন-জোড়ানো কিছু না পেয়ে আবার দোকানের দিকে তাকাল। তার মোটরটাকে সে এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে।
দোকানে ছ্যাঁচা বেড়ায় একটা ফ্রেমে-বাঁধানো ছবি আটকানো। চন্দন অলস চোখে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আন্দাজ করার চেষ্টা করল, ছবিটা কীসের। ছবি যতটা বিবর্ণ তার থেকেও অপরিচ্ছন্ন কাচটা। ঠাওর করতে না পেরে, কৌতূহলবশেই সে উঠে ছবির কাছে এল।