চোখে চোখ রেখে ওরা তাকাল। অমিয়ার চাউনি কসাইয়ের ছুরির মতো শান দিচ্ছে। মাংসের খোলা হাঁড়িতে চোখ পড়ল প্রমথর, থকথক করছে যেন রক্ত।
কী বুঝেছ তুমি, বলো কী বুঝেছ?
দু-হাতে অমিয়ার কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিল প্রমথ। খোঁপাটা খুলে পড়ল, চোখদুটো মরা পাঁঠার মতো ঘোলাটে হয়ে এল, ঠোঁট কাঁপিয়ে অমিয়া বলল, তুমি আমার গায়ে হাত তুললে।
অন্ধকার উঠোনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পুতুল আর বাবু। কোনো সাড় নেই যেন ইন্দ্রিয়গুলোর। তবু ছাদে যাওয়ার সময় প্রমথর নাকে চড়াভাবে লাগল পাউডারের গন্ধ। মেয়েটা সেজেগুজে অপেক্ষা করছে, করুক। মাথা নীচু করে প্রমথ ওদের পাশ দিয়েই ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি ধরল।
ছাদেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাধু ডেকে তুলল প্রমথকে। থালার সামনে বসে আছে অমিয়া। ঠাণ্ডা ভাত আর মাংস। ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়েছে।
পুতুল শুয়ে পড়ল যে এর মধ্যে।
শরীর খারাপ, কিছু খায়নি।
কথা দুটো শুকনো কড়কড়ে। খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত আর কেউ উচ্চবাচ্য করল না। মাংসের সবটুকুই খেল প্রমথ। শুধু মেটুলির টুকরোগুলো ছাড়া। মেটুলি ভীষণ ভালোবাসে অমিয়া, অথচ সবটুকুই সে প্রমথকে দিয়ে দেবে। প্রমথও না খেয়ে বাটিতে রেখে দেবে। তখন মিষ্টি ঝগড়া ভালো লাগত আর মাংসও আসত নিয়মিত। আজকেও প্রমথ মেটুলি রেখে উঠে পড়ল। কলতলায় অনেকক্ষণ ধরে কষের দাঁত থেকে মাংসের আঁশ টেনে বার করল। ভিজে গামছা দিয়ে গা-মুছে যখন সে শুয়ে পড়ল তখনও অমিয়ার রান্নাঘর ধোয়া শেষ হয়নি।
অনেক রাতে উঠোনে বেরিয়ে এল প্রমথ। ঘরের মধ্যে যেন চিতা জ্বলছে। একটুও হাওয়া নেই, মেঘও নেই। পায়চারি শুরু করল সে রকের এমাথা-ওমাথা। একটা এরোপ্লেন উড়ে গেল। মুখ তুলে তাকল প্রমথ। একটুখানি দেখা গেল, লাল আর সাদা আলোটা পালটা পালটি করে জ্বলছে আর নিভছে। মাত্র কতকগুলো তারা দেখা যায় উঠোন থেকে। ছাদে উঠলে আরও দেখা যাবে। দেখেই বা কী হবে ওরাও তো দেখল আজ মাংস এসেছে অনেকদিন পর, কিন্তু তাতে হল কী? পাতে মেটুলি রেখে সে উঠে পড়ল আর নির্বিকার হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল অমিয়া। এখন মনে হচ্ছে অমিয়া যন্ত্রের মতো তাকিয়ে ছিল। কিন্তু সেও তো যন্ত্রের মতোই শুধু অভ্যাস মেনে মেটুলিগুলো পাতে রেখে দিয়েছিল। পায়চারি থামাল প্রমথ। অমিয়াও উঠে এসেছে।
ঘুম আসছে না বুঝি?
না, ভয়ানক গরম লাগছে।
পিঠের কতকগুলো ঘামাচি মারল অমিয়া। দু-একটা শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল প্রমথ।
ছাদে যাবে?
কেন, এই তো বেশ।
বরাবরই তোমার কিন্তু ঘামাচি হয়।
অমিয়া পিঠের উপর কাপড় টেনে দিল।
বসবে?
পাশাপাশি বসল দুজনায়।
পুতুলের জন্য ছেলে দ্যাখো এবার।
হ্যাঁ, দেখব।
চাঁদুটাকেও একটা যা হোক কাজেকম্মে ঢুকিয়ে দাও, কদ্দিন আর টোটো করে কাটাবে।
হ্যাঁ, চেষ্টা করতে হবে।
রাধু বলছিল আই এ পরীক্ষাটা দেবে সামনের বছর।
ভালোই তো।
শান্ত রাত্রির মাঝে ওদের আলাপটা, কল থেকে একটানা জল পড়ার মতো শোনাল। ওরা অনেকক্ষণ বসে রইল চুপচাপ, পাশাপাশি। কেউ কারুর দিকে তাকাচ্ছে না। দুজনেরই চোখ সামনের শ্যাওলা-ধরা দেয়ালটাকে লক্ষ করছে।
কী দরকার ছিল মাংস আনার।
অমিয়ার স্বরে ক্ষোভ নেই, তাপ নেই, অনুমোদন নেই। শুধু যেন একটু কৌতূহল। তাও ঘামাচি মারার মতো নিস্পৃহ। মুখ না ফিরিয়ে প্রমথ বলল, কী জানি। তখন কেমন ভালো লাগল, অনেক কথা মনে পড়ল, মনটাও খুশি হল। ভাবলুম আজ সবাই মিলে একটু আনন্দ করব।
চুপ করে রইল প্রমথ। মুখ ফিরিয়ে একবার তাকাল। অমিয়াও তার দিকে তাকিয়ে।
আজ পুতুলকে দেখে বার বার তোমার কথা মনে পড়ছিল। কত মিষ্টি ছিলে, চঞ্চল ছিলে, ছটফটে ছিলে। আর ওকে কাঁদিয়ো না।
মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল প্রমথ, তারা জ্বলছে। একটা কামার মানুষকে তাতিয়ে বিরাট এক হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চলেছে, তারই ফুলকিগুলো ছিটকে উঠেছে আকাশে। ছাদে উঠলে আরও অনেক দেখা যাবে। অমিয়ার পিঠে হাত রাখল প্রমথ। থরথর করে কাঁপছে ওর পিঠটা।
জানো অমি, মনে হচ্ছে আমি আর ভালোবাসি না, বোধহয় তুমিও বসো না। তা-না-হলে তোমার মনে হবে কেন আমি তোমার গায়ে হাত তুলতে পারি। অথচ সত্যি সত্যি তখন ইচ্ছে হয়েছিল তোমার গলা টিপে ধরি। অমি, এখন একটা মড়া আগলে বসে থাকা ছাড়া আর আমাদের কাজ নেই।
অমিয়ার পিঠে হাত বোলাল প্রমথ। খসখসে চামড়া, মাংসগুলো ঝুলে পড়েছে আলগা হয়ে, মেরুদন্ডের গিটগুলো হাতে আটকাচ্ছে। মুখ তুলল প্রমথ, যে-কটা তারা দেখা যায়, সেদিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল, কেঁদো না, মরে গেলেই মানুষ কাঁদে, আমি কি মরে গেছি।
তারপর ওরা বসে রইল অন্ধকারে কথা না বলে।
মুক্তো
গাড়িটা যে এইভাবে পথে বসাবে, চন্দন মিত্র তা ভাবতে পারেনি।
ভোরে দিঘা থেকে রওনা হয়ে খড়গপুর পর্যন্ত মসৃণভাবে এসেছে। ব্রততী আর এক বছরের বাবলুকে জামশেদপুরের ট্রেনে তুলে দিয়েছে চন্দন। ব্রততী যাবে বড়োদিদির কাছে, থাকবে দিন পনেরো। দিঘায় ওরা দু-দিন ছিল চন্দনের এক অনুরাগীর বাড়িতে।
পুরোনো স্ট্যাণ্ডার্ড হেরাল্ড। চন্দন ছ-হাজার টাকায় কিনেছে চার মাস আগে। গাড়ি চালানোটা শিখবে শিখবে করেও শেখা হয়নি। ড্রাইভার রেখেছে। মাসে তিনশো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা ওর গায়ে লাগে। কেমন একটা ভয় ওর আছে, নিজে গাড়ি চালালে অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলবে।
চার বছর আগে জ্যোতিষী কোষ্ঠীবিচার করে যা যা বলেছিল তার অধিকাংশই মিলে গেছে। যেমন বিদেশে ভ্রমণ, যশ-খ্যাতি, আর্থিক সাফল্য, বিয়ে, চাকুরি—সবই প্রায়। এশিয়ান গেমস খেলতে ব্যাঙ্কক, তেহরান, ইণ্ডিয়া টিমের সঙ্গে হংকং, নাইরোবি, সিঙ্গাপুর, কাবুল, কলম্বো, রেঙ্গুন। মারডেকা খেলতে দু-বার কুয়ালালামপুরে। যশ ও খ্যাতি ব্যাপারটা কেমন চন্দন সেটা ঠিক বুঝতে পারে না। সে শুধু লক্ষ করেছে বাড়ির বাইরে মানুষজন তাকে দেখলেই তাকায়, মেয়েরা ফিসফাস করে। গাড়িওলা লোকেরা তাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে লিফট দিতে চায়, অপরিচিতরা বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে। ফুটবল ফাইনালে পুরস্কার বিতরণ ও দু-চার কথা বলার জন্য প্রায়ই ডাক আসে। তার নামে খবরের কাগজে হেডিং হয়; চন্দনের সৌরভ বা সুরভিত চন্দন-জাতীয় বিশেষণ তার খেলার দক্ষতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এক বার ট্যাক্সিতে যাবার সময় কানে এসেছিল, ভগবানের ছেলে যাচ্ছে রে! তার ক-দিন আগেই শিল্ড ফাইনালে যুগের যাত্রী জিতেছিল তার দেওয়া একমাত্র গোলে। এসব ব্যাপার যদি যশ বা খ্যাতি হয় তাহলে চন্দন যশস্বী এবং খ্যাতিমান।