দাও আরও আদর। দিন দিন যেন বাঁদরি তৈরি হচ্ছে। অনেক দুখ আছে ওর কপালে, বলে রাখলুম।
হাঁড়ি নিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছে অমিয়া প্রমথ নরমসুরে বলল, আজকে না বলেই হত।
কেন, আজ রথ না দোল যে বকব না।
শোওয়ার ঘরে এল প্রমথ। পুতুল ফোঁপাচ্ছে স্তুপ করা বিছানায় মুখ গুঁজে। শব্দটা সর্দি ঝাড়ার মতো শোনাচ্ছে। তার ওপর প্যাচপেচে গরম।
লক্ষ্ম মা আমার ওঠ, যা রান্নাটা শিখে নে। আরে বোকা শ্বশুরবাড়িতে যখন রাঁধতে বলবে
তখন যে লজ্জায় পড়বি, আমাদেরও নিন্দে হবে।
পুতুলের ফোঁপানি থামল। একটা চোখ বার করে, স্বরটাকে নামিয়ে বলল, বিয়ে করলে
হেসে উঠল প্রমথ, পুতুল মুখ লুকোল।
তোর মাও বিয়ের আগে ঠিক অমন কথা বলত।
পুতুল আবার মুখ তুলল। চোখের কাজল ধ্যাবড়া হয়ে গেছে। আহা, মেয়েটা কেঁদেছে।
তুমি কি করে জানলে, মা বুঝি বলেছিল?
একই সঙ্গে দু-জনে দরজার দিকে তাকাল। না অমিয়া নয়, খোকন এল।
চোখাচোখি হল পুতুল আর প্রমথর, হাসল দুজনেই। মেয়েটা দারুণ ভীতু হয়েছে। ওর মাও অমন ছিল, খালি দরজার দিকে তাকাত। রাত্রে ছাদে উঠত, তাও কত ভয়ে ভয়ে।
বল না, মা বুঝি সেসব গপ্পো করেছিল?
হেসে খোকনের চুলে বিলি কাটল প্রমথ। সেসব গল্প কবে করেছিল অমিয়া, তা কি এখনও মনে আছে। চেষ্টা করলে টুকরো টুকরো হয়তো মনে পড়বে। কিন্তু সেকথা কি মেয়েকে বলা যায়। একদিন, গলি দিয়ে গিয়েছিল একটা বেলফুলওয়ালা, কত কান্ড করে মালা কেনা হয়েছিল। আর একদিন, ছাদের উত্তর-পুব কোনায় তুলসীগাছের টবটার পাশে একটা ছোট্ট পৈঠে ছিল, একজন মাত্র বসতে পারে। পাছে বাবার ঘুম ভেঙে যায় তাই চুড়িগুলোকে হাতে চেপে বসিয়ে, পা টিপেটিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ছুট দিয়েছিল অমিয়া রকটা লক্ষ করে। আচারের শিশি বিকেলে তুলে রাখতে ভুলে গিয়েছিল, ছাদের মধ্যিখানেই পড়েছিল সেগুলো। তারপর সে কী কেলেঙ্কারি। বড়োবউদি ছাদে উঠে এসেছিল, আর অমিয়া পাঁচিল ঘেঁষে বসে পড়েছিল দু-হাতে মুখ লুকিয়ে।
হাসছ কেন!
এমনি। একটা কথা মনে পড়ল তাই।
অমন করে হাসলে কিন্তু তোমায় কেমন কেমন যেন দেখায়। বেশ লাগে দেখতে।
চোখ নামিয়ে হাসল প্রমথ। খোকন চলে গেল রান্নাঘরে। খুন্তি নাড়ার শব্দ আসছে, গন্ধও আসছে কষা মাংসের, রান্নাঘরে অমিয়ার কাছে এখন কেউ নেই। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমছে গালে, কপালে, নাকের ডগায়। বার বার কাঁধে গাল ঘষার জন্যে ঘোমটা খুলে গেছে। দুহাত সকড়ি, ঘোমটা তুলে দেওয়ার কেউ নেই কাছে।
বসেই থাকবি, নাকি রান্নাঘরে যাবি।
না, আমি শিখব না।
তোর মার কাছে শেখার জন্যে পাড়ার মেয়েরা আসত, বাটি বাটি মাংস যেত এবাড়ি ওবাড়ি।
অবস্থা ভালো ছিল তাই মা শিখতে পেরেছিল, আমি তো কোনোদিন রাঁধলুমই না।
ওর বয়সেই মেয়েরা বিয়ের কথা ভাবে। অমিয়া বলেছিল, সেও ভাবত, আর ভাবে বলেই একতলার ঘুপচি ঘরে জীবনটা সহনীয় হতে পারে। সচ্ছল ঘরে পুতুলকে দেওয়া যাবে না, টাকা কোথায়। মেয়েটা সে কথা ভেবেও হয়তো ভয় পায়। আসলে ভয় তো সকলেই পাচ্ছে, পুরুষ-মেয়ে সকলে। নতুন বউ অমিয়ার সময় মাংসের সের ছিল ছ আনা আট আনা, পুতুলের সময় তিন টাকা। জিনিসপত্তরের দাম বাড়ার জন্যে স্ট্রাইক হবে, হোক। মিহিরবাবু কবিতা লিখলেও বাজে কথা বলে না। খুন্তির শব্দ আসছে, কষা মাংসের গন্ধ আসছে, মেয়েটার মুখ শুকনো। অসহ্য লাগছে এই ঘরটা।
পুতুল আর প্রমথকে দেখে গম্ভীর হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসল অমিয়া। আলুর খোসা নিয়ে খেলা করছিল খোকন। পুতুল তাড়াতাড়ি কেড়ে নিয়ে কুটনোর ঝুড়িতে রেখে দিল, খোসা-চচ্চড়ি হবে।
গন্ধ উঠছে। এমন গন্ধ অমিয়ার হাতেই খোলে। ফুসফুস ভরিয়ে ফেলল প্রমথ। অমিয়ার গা ঘেঁষে পুতুল বলল, দাও না আমাকে।
উত্তর না দিয়ে অমিয়া শুধু খুন্তিটা নাকের কাছে ধরল। গনগনে আঁচ। একটুক্ষণ খুন্তি-নাড়া থামলেই তলা ধরে যাবে। পুতুলের কথায় কান দেওয়ার ফুরসত নেই, পুতুল করুণ চোখে তাকাল প্রমথর দিকে।
দাও না ওকে, যখন রাঁধতে চাইছেই।
সবই যখন করলুম তখন বাকিটুকুও করতে পারব। খোকনের ঘুম পেয়েছে শুইয়ে দে।
সত্যিই তো! এখন আর করার আছে কী। জলভরা কাঁসিটা হাঁড়ির মুখে চাপা দেওয়া ছাড়া। মাংসের জল বেরোলে, কাঁসির উষ্ণ জলটা ঢেলে দেওয়া, সে তো একটা আনাড়িতেও পারে। তারপর সেদ্ধ হলে আলু, নুন আর ঘিয়ে রসুন ভেজে সাঁতলানো, ব্যস। হতাশ হয়ে তাকাল প্রমথ। হনুর গড়নের জন্যে এমনিতেই পুতুলের গালদুটো ফুলো দেখায়, এখন যেন আরও টেবো দেখাচ্ছে। ভাঙা ভাঙা স্বরে সে বলল, তৃপ্তিকে ওর বউদি নিজে থেকে রান্না শিখিয়েছে, গোটা ইলিশ কাটা শিখিয়েছে, এবার ওদের মাংস এলে তৃপ্তি রাঁধবে সেদিন আমায় খাওয়াবে বলেছে।
তাহলে তো তোকেও একদিন খাওয়াতে হয়।
হয়ই তো, আজকেই তো ওকে বললুম আমাদের মাংস এসেছে, মা বলেছে আমি রাঁধব।
অমিয়ার দিকে চোখ রেখে এরপর পুতুল কিন্তু কিন্তু করে বলল, ওকে আমার রান্না খাওয়াব বলেছি।
গৌরদাও আজ বলল, দিও হে বউমার হাতের রান্না। অনেকদিন খাইনি, কোথেকে শুনল কে জানে, বললুম দেব পাঠিয়ে। আহা বুড়ো মানুষটার যা কষ্ট, ছেলেবউরা তো একটুও যত্ন করে না।
হ্যাঁ, পুলুদার বউ কী ভীষণ চালবাজ, একদিন গেছলুম সে কী কথাবার্তা যেন কত বি এএম এ পাস। কারুর আর জানতে যেন বাকি নেই দু-দুবার আই এ-ফেল, তবু বলে বেড়ায় পাস করেছে। আর রাস্তা দিয়ে হাঁটে যখন, তুমি দেখেছ বাবা যেন, সুচিত্রা সেন চলেছে।