থাক, তোমার আর কাজ দেখাতে হবে না।
অমিয়ার হাতে মশলা লেগে, হাত ধুয়ে জলভরা বাটিটা রেখে দিল সে। শিলের ধারে আদাগুলো ঘষে নিয়ে বাটতে শুরু করল। কত সহজে কাজটা করে ফেলল ও, প্রমথ ভাবল, এটাও এসেছে ওই অভ্যাস থেকে। হাত-পোয়া জলটুকু অমিয়া তো নর্দমাতেও ফেলতে পারত।
বাড়িতেই বসে থাকবে নাকি, বেরোবে না?
কোনো কথা বলল না প্রমথ। অমিয়া মুখ ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে।
খোকনের একটা ভালো নাম ঠিক করতে হবে।
করো-না।
উকিলবাবুর ছেলেদের নামগুলো বেশ। ও
রা সাহেবি স্কুলে পড়ে শুনেছি, ছছাটোটা তো খোকনের বয়সি।
হ্যাঁ, বড়োটা শুনেছি ইংরেজিতে কথা বলতে পারে।
রামগতির পাঠশালায় খোকনকে ভরতি করে দিয়ো, দুপুরে বড্ড জ্বালায়।
উঠে পড়ল প্রমথ। ভেবেছিল আজ আর বাড়ি থেকে বেরোবে না। মাংস ফুটবে, ছেলে মেয়েরা কাছাকাছি জড়ো হবে, গল্প হবে এটা-সেটার, আসন পেতে থালা সাজিয়ে দেবে অমিয়া, একসঙ্গে সকলে খেতে বসবে গরম ভাত, গরম মাংস। অমিয়া তাকিয়ে আছে; গলায় চটের মতো ঘামাচি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল প্রমথ।
উকিলবাবুর রকে বসে ছিলেন গৌর দত্ত। প্রমথকে দেখে কাছে ডেকে বললেন, দেখেছ কেমন গরম পড়েছে, এবার জোর কলেরা লাগবে।
নড়েচড়ে বসলেন গৌর দত্ত। প্রমথ ওঁর পাশে বসল।
শুধু কলেরা, আবার ইনফ্লুয়েঞ্জাও শুরু হয়েছে।
লক্ষ করে দেখলুম জানো…
গৌর দত্ত প্রমথর গা ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে প্রায় যে-সুরে অনিল কুন্ডুকে তার সংসার থেকে বিধবা ভাজকে আলাদা করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই সুরে বললেন, লক্ষ করে দেখলুম জানো বোমাটা ফাটার পরই এই ইনফ্লুয়েঞ্জা শুরু হয়েছে, গরমও পড়েছে, ঠিক কি না?
হ্যাঁ, গরমটা এবারে তিষ্টোতে দিচ্ছে না।
লক্ষ করেছ যত বোমা সব জাপানের কাছাকাছি ফাটাচ্ছে। তার মানে কী? ইণ্ডাস্ট্রিতে খুব ফরোয়ার্ড বলেই তো ওদের এত রাগ! আমাদের পুলুর আপিসে একটা জাপানি আসে, ভালো
ইংরেজি জানে না, কথা বলতে খুব অসুবিধে হয় পুলুর, ও তো ফার্স্ট ডিভিশনে বিএ পাস করা। তা জিজ্ঞেস করেছিল নেতাজির কথা। ওরা আবার আমাদের চেয়েও শ্রদ্ধাভক্তি করে। কী উত্তর দিলে জান? বোসের মতো কেউ থাকলে তোমাদের ফাইভ ইয়ার প্ল্যানগুলোয় চুরি হত না। ব্যাপারটা বুঝতে পারলে?
হ্যাঁ, জিনিসপত্তর যা আক্র হচ্ছে দিন-কে-দিন। মাংস তিন টাকায় উঠেছে।
এনেছ বুঝি আজ?
সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন গৌর দত্ত। অন্যমনস্কের মতো লাঠিটা ঘোরাতে ঘোরাতে আবার বললেন, কী গরম পড়েছে, টিকে নিয়েছ? খাওয়া-দাওয়া সাবধানে কোরো। ছেলেপুলের সংসার, বলা যায় না কখন কী হয়।
হলে আর কী করা যাবে, সাবধানে থেকেও তো লোকে রোগে পড়ে।
ওই তো ভুল কর। আজ তোমার যদি—ভগবান না করুন, ভালো-মন্দ কিছু-একটা হয় তখন সংসারের অবস্থাটা কী হবে ভেবেছ?
অস্বস্তিতে ছটফট করে উঠল প্রমথ। এসব কথা এখন ভালো লাগছে না। বোধ হয় সংসারে গৌর দত্তর আর কিছু দেওয়ার বা নেওয়ার নেই। চাগিয়ে তোলা দরকার, আহা বুড়ো মানুষ!
একটু চাখবেন নাকি?
কী এনেছ, খাসি? রাং না সিনা?
গর্দানা।
এ হে, খাসির রাং দারুণ জিনিস।
গৌর দত্তর গালে যেন পিঁপড়ে কামড়াল। চুলকোতে চুলকোতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।
বুঝলে, আগে খুব খেতুম। সামনে জ্যান্ত পাঁঠা বেঁধে রেখেই হাঁড়ি হাঁড়ি ভাত উড়িয়ে দিতে পারতুম। এখন ছেলেরা লায়েক হয়েছে, রোজগার করছে, বউদের হাতে সংসার। পুলুটাও হয়েছে বইন্যাওটা, বুড়ো বাপের যত্ন-আত্তির দিকে নজর নেই। তোমার বউদি বেঁচে থাকলে এ অবস্থাটা হত না।
টিকিট কাটার সঙ্গে সঙ্গে বাস বিকল হলে যাত্রীদের মনের অবস্থার মতো আস্তে আস্তে থেমে গেলেন গৌর দত্ত।
দুঃখ হচ্ছে প্রমথর। বুড়ো মানুষটার নিজের বলতে আর কিছু নেই। এখন কোনোরকমে টেনেটুনে চিতায় ওঠার অপেক্ষা। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন জীবনটা ধুকপুক করবে, সাধ-ইচ্ছে তৈরি হবে, পূরণ করতে চাইবে, অথচ পারবে না। এমন বাঁচার থেকে মরা ভালো। আহা, বুড়ো মানুষটা মরবেই-বা কেন?
চলুন গৌরদা, আজ একটু বেড়িয়ে আসা যাক গঙ্গার ধার থেকে।
সে বড়ো দূর ভাই, তার চেয়ে পার্কে বরং গোটা কতক চক্কর দিয়ে আসি।
দুজনে উঠে দাঁড়াল। রাধু বাড়ি ফিরছে। প্রমথ তাকিয়ে থাকল তার দিকে। জড়সড় ভঙ্গিতে ওদের পাশ দিয়ে রাধু চলে গেল।
তোমার বড়োছেলেটি ভালো।
হাসল প্রমথ।
হাঁটতে হাঁটতে গৌর দত্ত বললেন, ওরা আবার খুঁজবে হয়তো।
পার্কে ঢুকেও আগের কথার জের টেনে তিনি বললেন, খুঁজলে আর কী হবে, নিজেরাই গপ্পোটপ্পো করবে। আশুর মেয়েকে নাকি মারধর করেছে শাশুড়ি, আজ ওর যাওয়ার কথা ছিল, কী ফয়সালা হল কে জানে। আমি তো বলেছিলুম হাতে-পায়ে ধরে মিটিয়ে আসতে। খাট-বিছানা-টাকা তো এজন্মে দেওয়ার ক্ষমতা হবে না আশুর।
প্রমথর এসব কথায় কান নেই, সে তখন ভাবছে পুতুল এতক্ষণে ফিরেছে ওর বন্ধুর বাড়ি থেকে। উনুন ধরিয়েছে। অমিয়া ওকে দেখিয়ে দিচ্ছে কেমন করে খুন্তি ধরলে মাংস কষতে সুবিধে হয়। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে মেয়েটার কপালে, নাকের ডগায়। ঠোঁট দুটো শক্ত করে টিপে ধরেছে। চুড়িগুলো টেনে তুলেছে— দপদপে স্বাস্থ্য, বেশিদূর উঠবে না। পাতলা ভাপ উঠছে হাঁড়ি থেকে। না, এখনই কি উঠবে। এখন তো জলই বেরোয়নি। আগে তো কখনো রাঁধেনি, নিশ্চয় বুক দুরদুর করছে আর আড়চোখে তাকাচ্ছে অমিয়ার দিকে। অমিয়া কী করছে? গালে হাত দিয়ে পিঁড়িতে বসে দেখছে। কী দেখছে, পুতুলকে? তাই হবে। হয়তো খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে ওর কচি মুখটা; আর ভাবছে হয়তো যে-কটা গয়না আছে ভেঙে কী কী গড়াবে ওর বিয়ের জন্যে। এতক্ষণে গন্ধে ম-ম করছে বাড়িটা। থোকন নাক কুঁচকে শুকছে। ভালো লাগছে গন্ধটা, তাই মিটিমিটি হাসছে আর হাঁড়ির কাছে আসার তাল খুঁজছে। পারবে না, অমিয়ার নজর বড়ো কড়া।