ক্লান্ত আনন্দ কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙাল বিপিন। ঘরে আলো জ্বলছে। মেজদা বাইরের বারান্দায় ট্রানজিস্টারে বি বি সি-তে কান পেতে রিলে শুনছে।
ওঠো ওঠো, না খেয়ে শুয়ে কেন? দুবার ডাকতে এসে ঘুরে গেছি।
আনন্দ বিছানায় উঠে বসে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, বিপিনদা আমার বুকে কেমন একটা কষ্ট হয়। গাঁটে গাঁটে ব্যথা, শ্বাস নিতে পারি না ছোটাছুটি করলে।
হবে না? দিনরাত লাফানি ঝাঁপানি, চোট তো লাগবেই। মালিশ করে দোবখন। এখন খেতে চললো।
ঘরে ঢুকল অরুণ। বিব্রত থমথমে মুখ। ট্রানজিস্টারটা কানে চেপে ধরে খাটে বসল।
দুদিন বাকি, ম্যাচ বাঁচাতে পারবে?
উত্তর পাবে এমন আশা আনন্দ করেনি তাই জবাব না পেয়েও সে আবার বলল, ছশো উনত্রিশ আর ভারতের তিনশো দুই, তার মানে দুশো সাতাশ রানে পিছিয়ে, ইনিংস ডিফিট না হয়।
অরুণ হাত তুলে ওকে চুপ করতে বলে আরও কুঁজো হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে রেডিয়োটা কানে চেপে ধরল।
টু ফর নান ছিল, এখন কত?…গাভাসকর আছে তো?
আনন্দ উঠে এসে অরুণের গা ঘেঁষে বসল। ঘর্ঘর আজেবাজে শব্দের মধ্য দিয়ে একটা গলা উঠছে নামছে। সাহেবদের বলা ইংরেজি আনন্দ ঠিকমতো বুঝতে পারে না।
হানড্রেড ফরটি টু না টু হানড্রেড ফরটি টু ঠিক বুঝতে পারছি না। এত ডিসটার্বেন্স হয়।
আনন্দ কী একটা বলতে যাচ্ছিল, অরুণ হাত তুলে চুপ করতে বলে আবার বারান্দায় গেল। আনন্দ তোয়ালে নিয়ে ভাবল, স্নান করতে যাবে কি যাবে না। দেয়াল-ঘড়িতে রাত সাড়ে সাতটা। বারান্দায় অরুণ কুঁজো হয়ে, রেডিয়োর অ্যান্টেনাটা তার কান ঘেঁষে থরথরিয়ে কাঁপছে লাউডগার মতো।
স্নান করে, খেয়ে, উপরে এসে দেখল অরুণ খাটে দুহাতে চোখ ঢেকে শুয়ে আনন্দর পায়ের শব্দে তাকাল। আনন্দ স্কোর জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, তার আগেই অরুণ বলে উঠল, শ্যেম, শ্যেম। ওনলি ফরটি টু—বিশ্বাস করতে পারা যাচ্ছে না, মাত্র বিয়াল্লিশ!
অল আউট বিয়াল্লিশে! আনন্দও বিশ্বাস করতে পারছে না।
মাত্র সতেরো ওভারে, পঁচাত্তর মিনিটে ইনিংস খতম! কী লজ্জা!
আনন্দর মনে হল, তার বুকের মধ্যে একটা ব্যস্ততা ভীষণ উত্তেজনায় ছটফট করছে। ধড়ফড় করছে একটা কিছু। ধীরে ধীরে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
একজনও পেস খেলতে পারে না। পারবে কী করে, খেলেছে কখনও? দেশে কি ফাস্ট বোলার আছে?
আনন্দ মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। মেজদাটা আপনমনেই গজগজ করে যাচ্ছে। চোখ বুজল সে। সারা গায়ে যেন বেদনা চারিয়ে পড়ছে। হাঁটু কনুই কজি টনটন করছে। কপালে হাত রাখল। বোধহয় জ্বর আসবে।
এত বছর ধরে শুধু কথা আর কথা। তৈরি করা উচিত, তৈরি করতে হবে, অথচ কাজের কাজ কিন্তু একদমই হল না। এতবড় একটা দেশে কেউ জোর বল করতে পারে না, জোর বলে ব্যাট করতে পারে না! কী এমন বোলার ইংল্যান্ডের! আর্নল্ড আর ওল্ড। এই সেদিনই তো ওদের খেলল এখানে আমাদের এই ব্যাটসম্যানরাই, সিরিজও জিতল আর চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই এই অধঃপতন, বিয়াল্লিশ! ছি ছি ছি।
আনন্দর চোখ ভারী হয়ে জড়িয়ে আসছে। রেডিয়োর ঘরঘর শব্দ যেন সে শুনতে পাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের চিৎকার আর উচ্ছাস একসঙ্গে জট পাকিয়ে যাওয়ার মতো শব্দটা। আনন্দর মনে হচ্ছে, তাকে ঘিরেই পাক দিচ্ছে বিরাট এই উচ্ছ্বাস। এখন আর সে শোবার ঘরের বিছানায় নয়, লর্ডসে। ইংল্যান্ড ব্যাট করছে। বল হাতে সে ছুটে যাচ্ছে প্যাভিলিয়নের দিক থেকে। চিৎকার উঠছে: ফরটি টু… ফরটি টু। রিভেজ, রিভেনজ। ছিটকে পড়ল অ্যামিসের অফ স্টাম্প প্রথম বলেই। পরের বলে এডরিচের মিডল স্টাম্প। দুটো বলই অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে ছিটকে ঢুকে এসেছে। ডেভিড লয়েড ইয়র্কড হল তৃতীয় বলে। হ্যাটট্রিক! ইন্ডিয়ার নতুন ফাস্ট বোলারটি ক্ষেপে উঠেছে, ইংল্যান্ডকে চুরমার করতে তাণ্ডব শুরু করেছে বল নিয়ে। এরপর গ্রীগ, ফ্লেচার, ডেনেস, নট—আসছে আর যাচ্ছে। ইংল্যান্ড অল আউট ফরটি…না, থার্টি ফাইভ? ওয়ার্লড টেস্ট রেকর্ড নিউজিল্যান্ডের টোয়েন্টি সিক্স। তা হলে ইংল্যান্ডের টোয়েন্টি ফাইভ, পঁচিশ। নতুন রেকর্ড..রেকর্ড। লর্ডসে আগুন ছোটাব, আমি, ইন্ডিয়ার আনন্দ। সব লজ্জা অপমানের প্রতিশোধ নেব। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সে বিড়বিড় করল। অরুণ শুনতে পেল না।
মেজদা, আমি ফাস্টবোলার হব। কাল থেকে দারুণ প্র্যাকটিস করব। শুধু এই বুকের কষ্টটার জন্যই যা…
সকালে ঘুম ভাঙার পর আনন্দ সর্বাঙ্গে বেদনা এবং জ্বর জ্বর বোধ করল। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে হল না তার। উপুড় হয়ে বালিশে মুখ চেপে সে শুয়ে রইল।
খবরের কাগজের প্রথম পাঠক বাবা। সেটি বিপিনদা দোতলায় নিয়ে আসে সাড়ে সাতটায়। মেজদা কাগজটা পড়বে বিছানায় শুয়েই। তারপর পাবে আনন্দ। কাগজ পড়ার ইচ্ছা তার হচ্ছে না। মাথার মধ্যে যেন অনবরত বাম্পার চলেছে। চিড়িক দিয়ে লাফিয়ে উঠছে যন্ত্রণা। গাঁটে গাঁটে ব্যথা।
মেজদা, দ্যাখো তো আমার জ্বর হয়েছে কি না।
অরুণ মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ভ্রূ কুঁচকে বলল, গা গরম লাগছে? মাথা ভার ভার?
হ্যাঁ, গায়েও ব্যথা।
ইনফ্লুয়েঞ্জা।
অরুণ ওকে একগ্লাস জল ও একটা সাদা ট্যাবলেট দিয়ে, কপালে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, এখন খুব হচ্ছে। চান করবি না, ভাত খাবি না, দুপুরে ঘুম, দেখবি সেরে গেছে। আর একটা ট্যাবলেট রেখে দিচ্ছি, দরকার বুঝলে খাবি।