মন্দিরের বাগান থেকে হাসনুহানার গন্ধটা আনন্দর ভাল লাগল। ভিতরে এল সে। ব্যাডমিন্টন কোর্টের আকারের শ্বেত পাথরের ঠাকুরদালান। শঙ্খের কাজ করা খিলেন ও থাম, টানা পাঁচ সারি কালো পাথরের সিঁড়ি, ঝাড়বাতি। হাতে কিটব্যাগ, পায়ে চটি, তাই সিঁড়ির থেকে তফাতে দাঁড়িয়ে আনন্দ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিগ্রহের দিকে। বুকের ব্যথাটা এখন বোধ হচ্ছে না। ফুলের মিষ্টি গন্ধ বুকভরে টানল। শ্বাসকষ্ট হল না। ঠাকুর দালানটার পুব দিক উন্মুক্ত। সকালের রোদে শ্বেত পাথর ঠিকরে ওঠে। বিকেলে জল দিয়ে ধোয়ার পর শীতল হয়ে যায়। আনন্দর ইচ্ছা হল খালি গায়ে শুয়ে পড়তে। চটি খুলে সে ঠাকুরদালানে উঠে এসে বসল। আর তখুনি মনে পড়ল মাকে।
সন্ধ্যার শ্বেত পাথরের মতো ঠাণ্ডা ছিল মায়ের মেজাজ। প্রতি সন্ধ্যায় এসে আরতি না দেখলে ছটফট করত। ঠাকুরদালানে মা বসত চোখ বন্ধ করে, দুটি হাত কোলে রেখে, গলায় আঁচল, তার প্রান্তে চাবির থোকা। লালপাড় শাড়ির ঘোমটায় ঘেরা যেন। কুমোরের হাতে গড়া মুখ। আনন্দ একদৃষ্টে তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকত। হঠাৎ চোখ খুলে মা তাকাত। তারপর মুচকি হেসে আবার চোখ বন্ধ করত। ফিসফিস করে আনন্দ এক দিন বলেছিল, চোখ বুজে থাক কেন?
চোখ বন্ধ করলে যে ভাল দেখা যায়।
কী দেখো?
আমার আনন্দকে।
চাপা বাষ্প বুক থেকে গলা পর্যন্ত উঠে আনন্দর দুটি চোখকে ভিজিয়ে দিল। ধীর পায়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এল রাস্তায়। কয়েকটা লরি, রিকশা ছাড়া বীরা দত্ত রোড দিয়ে সন্ধ্যার পর কোনও যানবাহন যায় না। রাস্তাটা ফাঁকা। সামনে ইনস্টিটিউটের জীর্ণ পলেস্তরা খসা ঘরের জানলা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। ডগুদা এসে গেছে। খেলার মাঠে লরি দাঁড়িয়ে। তা থেকে লোহা নামাচ্ছে মজুররা। শিবা দত্তর কারখানায় তৈরি হয় সিলিং ফ্যান, সাইকেল, ওজন মেসিনের পার্টস এবং আরও কী সব যন্ত্রপাতি।
নিজেদের বাড়িটাকে প্রতিবারই দূর থেকে আনন্দের মনে হয় ছবিতে দেখা অতিকায় এক প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসোর। দোতলাটা অন্ধকার। মেজদা আসে দশটা-এগারোটায়। দালানের আলোটা জ্বললেও বাইরে থেকে বোঝা যায় না। সিং দরজা দিয়ে একচিলতে আলো বাইরে পড়েছে। বাবা এখন হয়তো চেম্বারে, বিপিনদা বলে সেরেস্তায় বসেছে। রাত্রে শোবার জন্য ছাড়া বাবাকে দোতলায় দেখা যায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই এবং কোর্ট থেকে ফিরেই একতলার ঘরে ঢুকে পড়ে।
ফটকের পর প্রায় দশ মিটার মাটির পথ। বাড়িটার তিনদিকে অনেকটা জমি। একমানুষ উঁচু পাঁচিলে সেটা ঘেরা। দেউড়ির দশ ফুট উঁচু সিং-দরজাটার ডান দিকে রেলিং দেওয়া অন্ধকার রক। আনন্দ পৌঁছল রকের প্রান্তে ছোট্ট একটা দরজায়। সেটা দিয়ে ঢুকেই বেলেপাথরের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে দরজাটার পাশ দিয়ে। সিঁড়ির ঘুলঘুলি থেকে আনন্দ স্কেল দিয়ে মেপে দেখেছে দেয়ালটা ঠিক দু ফুট আট ইঞ্চি চওড়া।
সিঁড়িতেও আলো নেই। দোতলায় দালানের আলোটাই কাজ চালিয়ে দেয় যখন, তা হলে আর দরকার কী? অনাদিপ্রসাদের এই যুক্তিটার প্রতিবাদ করে মেজ ছেলে অরুণ বলেছিল, ইলেকট্রিক বিল আমিই দেব।
আমার মরার পর।
অরুণ আর কথা বলেনি। শুধু গজগজ করে আনন্দকে শুনিয়ে বলেছিল, মধ্যযুগীয়, ডিক্টেটরি, ফিউডাল মনোবৃত্তি। এই করেই সব সম্পত্তি গেছে। আমরা গরিব হয়েছি।
আনন্দ জানে, এই বিরাট প্রাচীন বাড়িটা তাদের বনেদিয়ানা জাহির করলেও, আসলে তারা মধ্যবিত্ত। বাবার ওকালতির রোজগারে সংসারটা মোটামুটি স্বচ্ছন্দে চলে যায়, এই পর্যন্তই। মেজদার এক টাকাও বাবা নেয় না। মেজদা স্কুটার কিনেছে।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সে বুকে টান বোধ করল। দোতলায় পৌঁছে সে ভাবল, কী হল আমার! এটা কি ফুসফুসের অসুখ? তা হলে কি মার মতো মরে যাব! দেয়ালে সার দেওয়া অয়েল পেইনটিং। সবাই পূর্বপুরুষ। ছবিগুলোর ক্যানভাসের রঙ চটা; কালো হয়ে গেছে। কারুর মুখ কারুর হাত বোঝা যায় শুধু হলুদ রঙের জন্য। ছবির সোনালি ফ্রেমের খাঁজে খাঁজে ধুলো। নির্জন দালানের বিবর্ণ আলোয় মৃত মানুষগুলোকে দেখাচ্ছে যেন আর একবার মৃত্যুমুখীন। আনন্দর মনে হল, ওদের থেকেও সে এই মুহূর্তে বেশি নিঃসঙ্গ, বিপন্ন এবং ভীত। সারা বাড়িতে প্রাণের স্পন্দন। আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
মোটা মোটা দেয়াল, ছাদ ভেদ করে শব্দ যাতায়াত করে না এ বাড়িতে। স্যাঁতস্যাতে ঠাণ্ডা মেঝে, কোণে কোণে ভ্যাপসা গন্ধ। ছবির মানুষগুলোর কেউ খালি গায়ে মোটা পৈতে ঝুলিয়ে, কেউ জোব্বা গায়ে পাগড়ি পরে বছরের পর বছর গোমড়া মুখে, বসে বা দাঁড়িয়ে। আনন্দ করুণ চোখে ওদের সকলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে শোবার ঘরে এল।
দোতলায় শোবার ঘর দুটি। বাড়ির দুই-তৃতীয়াংশ, পিছন দিকের প্রায় সবটাই আনন্দর ঠাকুর্দা বিক্রি করে দিয়েছিলেন হীরা দত্তকে। সেই অংশটা এখন শিবা দত্তর কারখানার গুদাম। সামনের দিকটায় আনন্দরা থাকে। হলঘরের মতো লম্বা একটা ঘর, তার দুই প্রান্তে দেয়াল ঘেঁষে দুটি খাট। আনন্দ ও অরুণের। পাশের ঘরটা অপেক্ষাকৃত ছোট, অনাদিপ্রসাদ থাকেন। চার দেয়ালে চারটে দেয়াল-আলমারি এবং পাঁচ ফুট দীর্ঘ একটা আয়না ছাড়া ঘরের বাকি সবই আধুনিক।
আলো না জ্বেলে, আনন্দ শুয়ে থাকে খাটে। খিদে পাচ্ছে। অপেক্ষা করতে লাগল হাবুর মা-র জন্য। এই সময় সে দিয়ে যায় দুধ আর সেঁকা পাঁউরুটি। হয়তো জানে না আনন্দ ফিরেছে। স্নান করতে নীচে তো যেতেই হবে, তখন বরং খেয়ে নেবে।