মাস দুয়েক হল দেবু আর তাদের বাড়িতে আসে না। তার কারণটা এইরকম— কোর্টে সওয়াল করতে করতে অনাদিপ্রসাদ হাত বাড়ালেন দেবব্রতর দিকে। টেবলে লাল মলাটের বাঁধানো তিনখানা একই আকারের হৃষ্টপুষ্ট বই দেবব্রতর সামনে। হাত বাড়ালেই সে জানে পরের পর কোন বই অনাদিপ্রসাদের হাতে গছিয়ে দিতে হবে। দুরাত্রি জেগে তিনি বার করেছেন, ছত্রিশ বছর আগে মাদ্রাজ হাইকোর্টে ঠিক এইরকম মামলায় যে রায়টি দেওয়া হয়েছিল। বইয়ের সেই পাতায় ফ্ল্যাপ দেওয়া আছে। মামলায় সেই পুরনো রায়টা তাঁর পাশুপত অস্ত্র।
হাত বাড়িয়েও বইটা হাতে না আসায় অনাদিপ্রসাদ তাকালেন, এবং দেখলেন, দেবব্রতর চোখ বন্ধ, চিবুক নেমে এসেছে বুকের কাছে। চাপা গর্জন হল একটা। ধড়মড়িয়ে উঠে দেবব্রত চোখ খুলে দেখল প্রসারিত একটি হাত এবং তখনি টেবিল থেকে একটা লাল বই তুলে হাতে ধরিয়ে দিল।
নাটকীয় ভঙ্গিতে ফ্ল্যাপ দেওয়া পাতাটি খুলে পড়তে গিয়ে অনাদিপ্রসাদের ভ্র কুঞ্চিত হল। এটা পরের মামলার জন্য দরকার। তিনি আবার হাত বাড়ালেন। দেবব্রত ব্যস্ত হয়ে আর একটা লাল বই দিল। হ্যাঁ, এইটাই, কিন্তু হায়, বইয়ে যে ফ্ল্যাপের টিকিও দেখা যাচ্ছে না। কীভাবে এখনি বার করবেন রায়টা! অনাদিপ্রসাদ ফ্যালফ্যাল চোখে জজের দিকে আর জ্বলন্ত চোখে দেবব্রতর দিকে তাকান। মাথা চুলকে দেবব্রত বলল, ফ্ল্যাপ তো স্যার দেওয়াই ছিল! কোথাও পড়ে উড়ে গেছে বোধহয়, আমি খুঁজে দেখছি।
ফ্ল্যাপ খুঁজতে, কোর্ট রুম থেকে দেবব্রত দুমাস আগে সেই যে দ্রুতবেগে বেরিয়েছিল তারপর আজও প্রত্যাবর্তন ঘটেনি। আনন্দের বাড়ির ত্রিসীমানায় সে আর আসে না। কিছু বুঝে নেবার দরকার হলে আনন্দই যায় ওর বাড়িতে।
এখন নেতাজি পার্ক থেকে ফেরার পথে তার দেখা হল দেবব্রতর সঙ্গে। কালো কোট, সাদা টাউজার্স এবং হাতে একটা পেপারব্যাক ডিটেকটিভ বই। কোর্ট থেকে ফিরছে।
দারুণ মুশকিলে পড়ে গেছে রে মেইগ্রে।
দেবুদা বইটা মাথার উপর তুলে নাড়তে লাগল। খুনি ওকে অফিসে ফোন করেছে, চিঠিও লিখেছে।
মুশকিলটা কোথায়!
খুনিটা মানসিক রোগে ভুগছে। বুঝলি না, এসব ক্ষেত্রে হয়তো আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে।
যদি করেই, তাতে ক্ষতিটা কী? ধরা পড়লে তো ফাঁসিই হবে!
আহহা, বুঝছিস না। যদি আত্মহত্যা করে বসে, তা হলে তো কেউই জানতে পারবে না যে খুনিটাই মরেছে। প্যারিসে অমন কত লোকই তো রোজ মরছে। সুতরাং ওকে হাতেনাতে ধরতেই হবে। পাবলিককে দেখাতে হবে খুনি ধরা পড়েছে, নয়তো তারা নিশ্চিন্ত হবে কী করে? এদিকে মেইগ্রেকে দুদিন মাত্র সময় দিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট।
কীসের সময়?
খুনিদের একটা সায়কোলজি আছে। দেবুদা এধার-ওধার তাকাল, চল, হাঁটতে হাঁটতে বলছি। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে খুন নিয়ে আলোচনা করাটা ঠিক নয়। ভাল উকিল হতে হলে ডিটেকটিভের বুদ্ধি রাখতে হয়। তোর বাবা তো এসব বোঝেন না। শিবা দত্তর উকিল হয়ে সারাজীবন শুধু ভাড়াটেদের সঙ্গেই মামলা করে গেল। ব্রেইন…মেইগ্রের মতো ব্রেইন চাই উকিল হতে হলে।
কী যেন সায়কোলজির কথা বলছিলেন?
সায়কোলজি এমন ব্যাপার যা বই আর থিওরি দিয়ে বোঝা যায় না। জ্ঞান হয় বটে, কিন্তু ভাল স্কুলমাস্টার কি ঔপন্যাসিক কি একজন ডিটেকটিভ যতটা ভালভাবে মানুষকে বোঝে তেমন ভাবে বুঝতে পারা চাই।
উকিলদেরও তো তা হলে…।
নিশ্চয়, নিশ্চয়। দেবু হঠাৎ চুপ করে গেল একজন পথিককে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দেখে। একটু দ্রুত হেঁটে এগিয়ে গিয়ে বলল, তোর বাবার জুনিয়ার হয়ে থাকলে কোনও অভিজ্ঞতাই হবে না।
বাবা তো খুনের কেস করে না।
সেই জন্যই তো ছেড়েছি তোর বাবাকে।
কী যেন সায়কোলজি সম্পর্কে বলছিলেন?
খুনিদের মনস্তত্ত্ব! যেখানে খুন হবে সেখানে ওরা আসবেই। যাকে খুন করেছে। তার ফিউনারালে নিশ্চয় যাবে এটা ধরে নিয়ে মেইগ্রে এক ফটোগ্রাফারকে বলল। সেখানে উপস্থিত যাবতীয় লোকের এলোপাথাড়ি ছবি তুলে যাও। যদি একটা লোককে বেশির ভাগ ছবিতে পাওয়া যায় তা হলে তার পিছনে লোক লাগাবে। পাওয়া গেল একটা মুখ। কিন্তু অতবড় শহরে ওই মুখের লোকটাকে কী করে খুঁজে বার করা যায়!
কাগজে ছাপিয়ে দিক। কেউ না কেউ চিনে ফেলে পুলিশকে জানিয়ে দেবে।
তুই যে ম্যাজিস্ট্রেটের মতোই কথা বললি। সে তো মেইগ্রেকে দুদিন সময় দিয়েছে। খুনিকে হয় এর মধ্যে ধরে দাও, নয়তো ওই মুখটা কাগজে ছাপাতে পাঠাব। মেইগ্রে পড়েছে মুশকিলে। তার দৃঢ় ধারণা কাগজে নিজের ছবি দেখলেই খুনি নির্ঘাত আত্মহত্যা করে বসবে।
তা হলে? মেইগ্রে কী করল?
জানব কী করে, ট্রামে যা ভিড়, বইটা খোলার একটু চান্স পর্যন্ত পেলুম না।
দেবুদার হাঁটার গতি হঠাৎ বেড়ে গেল। আনন্দকে ফেলে রেখেই সে হনহনিয়ে তার বাড়ির পথ ধরল বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে। মেইগ্রে কীভাবে মুশকিল থেকে বেরিয়ে এল সেটা তাড়াতাড়ি জানা যাবে, তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে বইটা শেষ করতে পারলে।
বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে আনন্দ। বীরা দত্ত রোড শেষ হয়েছে যেখানে, তার পুবে দত্তদের রাধাগোবিন্দ মন্দির। পশ্চিমে বটতলা ইনস্টিটিউটের একতলা বাড়ি আর খেলার মাঠ। মাঠের তিনদিকে—আনন্দদের বাড়ি, শিবা দত্তর কারখানার। পিছন দিক এবং মহিম ব্যানার্জি লেন। কতকগুলো জীর্ণ একতলা কোঠাবাড়ি এবং টিনের চালার বাড়ি নিয়ে মহিম বাঁড়ুজ্যের গলিতে বটতলা নামে একটা পাড়া আছে। সন্ধে নামছে! আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই রাস্তার আলো জ্বালতে হুক লাগানো লাঠি হাতে করপোরেশনের লোক সুইচ টিপে টিপে চলে যাবে বীরা দত্ত রোড দিয়ে। রাধাগোবিন্দ মন্দিরে কাঁসর-ঘণ্টা বেজে উঠবে। ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরি খুলবে ডগুদা। কারখানা গেটের পাশে দয়ানিধির চায়ের দোকানের বেঞ্চে একটা-দুটো লোক হয়তো দেখা যাবে—ওভারটাইমের লোক।