মোটেই না। কোন সময়টায় এক হয়?
আনন্দ সেটা বোঝাবার জন্য পরপর বার তিনেক বল করার ও সার্ভিস করার মহড়া দিয়ে হাঁফাতে লাগল।
দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে একজন বলল, অনেকটা মিল অবশ্য আছে বটে।
আর একজন কিছুটা হালকা বিদ্রুপ নিয়ে বলল, বিজয় অমৃতরাজের সার্ভিস তো দারুণ, ওকেই তাহলে ফাস্ট বোলার করে নিলে কেমন হয়?
টেনিসে নাকি বলে স্পিন টিন করানো হয়, সত্যি নাকি রে আন্দ?… কী হয়েছে।
রে তোর, নেটেও দেখলুম হাঁপাচ্ছিস!
কিছু না, মাসলে কেমন একটা টান ধরছে বল করলেই। একটু আস্তে হাঁট।
আনন্দ বলতে পারল না, মাসলে টান ধরাটা বাজে কথা। শুধু জ্বর হয়েছে বললে ওরা ভাববে ছেলেটা ননীর পুতুল। বরং মাসল পুল শব্দটার মধ্যে যেন গায়ের জোরের ব্যাপারটা রয়েছে। কিন্তু ফাস্ট বোলারদের কি বুকের মাসল পুল করে? কাগজে তো লিলি বা রবার্টসের উরুর পেশিতে টান ধরার কথাই শুধু লেখে! ওদের কি এমন হাঁপ ধরার মতো ব্যাপার হয় না? ওদের ফুসফুস কি কখনও গোলমাল করে না? করলে, টানা দশ বারো ওভার বল করতে পারত না। তা হলে আমার ফুসফুসটাই কি বিগড়েছে?
মনে হওয়া মাত্র চুল থেকে একটা তরাস আনন্দর পায়ের আঙুল পর্যন্ত নেমে গেল। তা হলে বিপজ্জনক কিছু কি একটা আমার হবে? কিংবা হয়তো হয়েছে। সে ঘাবড়ে গিয়ে চারপাশে একবার তাকাল। প্রতিদিনের মতোই লোকেরা হাঁটছে, বাস মোটর রিকশা চলেছে, শব্দ হচ্ছে, অন্য দিনের থেকে কোনও পার্থক্য নেই। কিন্তু এখন তার চোখে পড়ল তিন তলার পাঁচিল থেকে একটি বাচ্চা মেয়ে প্রায় কোমর পর্যন্ত শরীরটা বার করে ঝুঁকে আছে, রাস্তার কল থেকে অযথা জল পড়ে যাচ্ছে, রেস্টুরেন্ট থেকে ওমলেট ভাজার গন্ধ নাকে এল, রেডিয়োতে কেউ আবৃত্তি করছে। কবিতা। হঠাৎ যেন তার চারপাশের পৃথিবী তাকে স্পর্শ করতে শুরু করল। আনন্দ আশ্বস্ত হয়ে নিজেকে বলল, নাহ্, কিছু হয়নি।
.
০২.
হাতির চারটে পা জড়ো করলে যতটা ঘের হয়, এমন মোটা এক একটা থাম। এইরকম চারটে থাম আনন্দদের বাড়ির ফটকে। তার পাশে দুটো পাম গাছ। বাড়ির মতো ওদেরও বয়স একশো বছরের উপর। আনন্দর বাবা অনাদিপ্রসাদ কথায় কথায় একদিন, তাঁর কাছে শিক্ষানবীশ সদ্য ওকালতি পাশ দেবব্রতকে বলছিলেন, কলকাতার এই দিকের ওয়ান-থার্ড জমি ছিল বাঁড়ুজ্যেদের। সিপাই-মিউটিনির আগের কথা। তখন রামমোহন, দেবেন ঠাকুরদের আমল। দত্তরা তখন কোথায় হে, সব জমিজমা ছিল আমাদের। এই শিবা দত্তর ঠাকুদ্দা এইটিন সেভেনটি সিক্সে, আমাদের কাছ থেকেই পাঁচ বিঘে জমি পেয়ে বসত করে। সে এক মজার ব্যাপার।
চোরবাগানের ঘোষেদের বেড়ালের সঙ্গে আমাদের বেড়ালের বিয়ে; আমার ঠাকুদ্দার মা বিয়ের দিন সকালে বায়না ধরল বরযাত্রী যাবে একশো বেড়াল। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে তিনি শয্যা নিলেন। রইরই পড়ে গেল—বেড়াল চাই, একবেলার মধ্যে একশো বেড়াল। বীরা দত্তর তেজারতি কারবার, কী একটা কাজে এসেছিল। বলল, আমি জোগাড় করে দেব, তবে বেড়ালপিছু এককাঠা জমি। করে। দিল জোগাড়। সেই দত্তদের এখন অবস্থা দেখো। কপাল, কপাল। বীরা দত্তর ছেলে হীরা দত্ত কলকাতায় এগারোটা বাড়ির মালিক হয়। পরে এ বাড়িতে আর থাকত না। পালোয়ান ছিল। ক্ষ্যাপা মোষের শিং ধরে মাটিতে ফেলে দিতে আমিই দেখেছি ছোটবেলায়। এই যে সামনের ছোট মাঠটা, শিবা দত্তর কারখানার পিছনে হে, যেটায় লরি রাখে, ড্রাম ট্রাম পড়ে থাকে, ওটা তো এখানকার ছেলেদের খেলার জন্য দান করে গেছে হীরা দত্ত। পুরো জমিটা দশ কাঠার। বটতলা ইন্সটিটুট, লাইব্রেরি, একসারসাইজ ক্লাব সবই তো ওরই করে দেওয়া।
অনাদিপ্রসাদের গল্প বলা বন্ধ হয় আনন্দর দিকে চোখ পড়তে। জিরান্ডিয়াল আর সিম্পল ইনফিনিটিভের মধ্যে তফাতটা দেবব্রতর কাছে বুঝে নেবার জন্য গ্রামার হাতে আনন্দ দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ সে অবাক হয়ে শুনছিল। সাধারণত সারাদিনে তার বাবা দু-চারটের বেশি কথা তার সঙ্গে বলেন না, মেজদা অরুণের সঙ্গেও নয়। সাংসারিক যাবতীয় কথা হয় হাবুর মা আর বিপিনের সঙ্গে। হাবুর মা ছাব্বিশ বছর এ বাড়ির রান্নাঘরের দায়িত্বে, চোখে কম দেখে; বিপিনকে একত্রিশ বছর আগে নিযুক্ত করেছিলেন আনন্দর ঠাকুর্দা। জুতো না পরে বাড়ির বাইরে যায় না। হুকুম দেবার তালিকায় এ বাড়িতে তার স্থান দ্বিতীয়।
আনন্দকে প্রায়শই পড়া বুঝে নিতে সাহায্যপ্রার্থী হতে হয় দেবব্রত অর্থাৎ দেবুদার। অনাদিপ্রসাদ প্রাইভেট টিউটর রাখার ঘোরতর বিরোধী। তাঁর ধারণা, ফাঁকিবাজ ছাত্রদের জন্যই বাড়িতে মাস্টার দরকার এবং তাই সেটা বাজে খরচ। আসলে অনাদিপ্রসাদ একটু কঞ্জুস, দেবব্রতকে দিয়ে পড়ানোর কাজটা করিয়ে নেবার জন্যই এই অজুহাত। দেবব্রত পাশের পাড়ার ছেলে, একটু ঘুমকাতুরে। আনন্দর বড়দা অমলের সঙ্গে স্কুলে এক ক্লাসে পড়ত। অমল যায় ডাক্তারিতে, দেবু ওকালতিতে। ছোট্টখাট্ট রোগা শরীর। চশমার দুটো কাচের পাওয়ার মাইনাস এইট এবং টেন। খুঁতখুঁতে এবং মানুষের সঙ্গে মিশতে অনিচ্ছুক। যেখানে সেখানে, যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ে। ওকালতি খুব একটা তার ভাল লাগে না। ভাল লাগে ঘুমোতে, ডিটেকটিভ বই পড়তে। ভীষণ ভক্ত ডিটেকটিভ মেইগ্রের।
মেইগ্রের মতোই, দেবু সব ব্যাপার একটু তলিয়ে বুঝতে চায়। সত্যসন্ধানী হওয়া উচিত মানুষ মাত্রেরই, দেবু প্রায়ই বলে। যা কিছু ঘটছে বা ঘটবে তার পিছনে কারণ থাকবেই। সেটাই হল সত্য। সেটা খুঁজে বার না করলে শুধু আইন টাইন দিয়ে সমাধান হয় না। আনন্দ বলেছিল, তা হলে একটা সমস্যার সমাধান করে দিন দেখি—আপনি যেখানে সেখানে কেন ঘুমিয়ে পড়েন? দেবু থতমত হয়ে তারপর বলেছিল, ঠিক আছে, রিসার্চ করে তোকে জানিয়ে দোব। চার দিন পরই দেবু একটা কাগজে তার গবেষণার ফল লিখে এনে আনন্দকে পড়ে শোনায়—ভাতই হল মূল কারণ। তারপরই চিনি দিয়ে তৈরি খাদ্য, আলু প্রভৃতি যাবতীয় কার্বোহাইড্রেট। মানুষের অন্ত্রনালিতে এগুলো গেঁজে উঠে ইথেনল তৈরি করে। এই জিনিসটার কেমিক্যাল নাম ইথেইল অ্যালকহল। বেশি পরিমাণে ভাত, মিষ্টি ইত্যাদি খেলে অন্ত্রে বেশি পরিমাণ ইথেনল তৈরি হয় যার ফলে শরীর ভার লাগে, চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে। তারপর দেবু বলে, এই ভাত খাওয়ার জন্যই বাঙালিরা কুঁড়ে। বুঝলি আনন্দ, আমি আজ থেকে ভাত খাওয়া ছেড়ে দিলুম। দুবেলা রুটি খাব। আনন্দ খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, তিন দিন পর্যন্ত সে ভাতের বদলে রুটি খেয়ে থেকেছিল। দেবুর আর এক অভ্যাস মাঝে মাঝে বলে ওঠা, আঃ, যদি লটারির একটা ফাস্ট প্রাইজ পেয়ে যাই!