ডগুদা তক্তপোশে পা ছড়িয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। থুতনিটা মুঠোয় ধরা। গভীরভাবে একটা কিছু চিন্তা করছে। তার পায়ের দিকে বসে আছে গীতা মাথা নিচু করে। সেও কিছু একটা চিন্তা করছে। আনন্দ দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই থতমত হল। লেডি সোবার্সকে এখানে দেখতে পাবে সে ভাবেনি। ওরা দুজনে চমকে উঠে তার দিকে তাকাল।
কী চাই? ডগুদা একটু রুক্ষস্বরেই বলল।
শুনলাম, আপনি নাকি চাকরি নিচ্ছেন শিবা দত্তর, এটা কি সত্যি!
ওরা দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ডগুদা সিধে হয়ে বসে বলল, হ্যাঁ। তাতে তোর কী?
তা হলে মাঠটার কী হবে?
ডগুদা চুপ করে রইল।
লাইব্রেরিটাও উঠে যাবে?
দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল ডগুদা।
মাঠে মেয়েদের ট্রেনিং বন্ধ হয়ে যাবে?
হ্যাঁ সব যাবে, সব বন্ধ হয়ে যাবে, তাতে আমার কী? আমি আর কোনও ঝামেলায় জড়াব না। এখান থেকে আমি চলে যাব। আমার বয়েস হচ্ছে, আর কটা দিনই বা বাঁচব।
ডগুদার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে হঠাৎ থেমে গেল। আনন্দর মনে হল এই ঘরটা যেন মাটির নীচে, তার চারদিক চাপা। এখানে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেমনভাবে দেবুদার কাছ থেকে উঠে এসেছিল, সেইভাবেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এল। আধ অন্ধকার রাস্তা দিয়ে সে মাঠের কাছাকাছি আসতেই পিছন থেকে অমল ডাকল।
কী বলল ওরা?
ওরা?।
ডগুদা আর মা?
জানো অমল এখন আমার ইচ্ছে করছে প্রচুর আলো প্রচুর হাওয়ার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে। চারিদিক এত দমবন্ধ করা লাগছে। ডগুদাকে খুব স্পিরিটেড, সৎ বলে জানতাম, কিন্তু শিবা দত্তর কাছে যে নিজেকে এত সহজে বিক্রি করে দেবে আমি ভাবিনি।
ওরা বিয়ে করবে তা হলে?
কী করবে? আনন্দ প্রায় চিৎকার করে উঠল।
ডগুদা আর তোমার লেডি সোবার্স। অন্য জায়গায় বাসা নিয়ে থাকবে, সেই কথাই ওরা আলোচনা করছিল।
তোমার মা…লেডি সোবার্স! কেন, কেন? থরথর কাঁপতে লাগল আনন্দ।
সকলের মতো ওরাও বাঁচতে চায় যে।
আমিও তো চাই। অমল অমল আমার কী হবে— আর্তনাদে চিরে গেল আনন্দর গলা।
তুমিও বাঁচবে, চিরকাল খেলা করে বাঁচবে।
হঠাৎ যেন বিরাট ঘুষির মতো কথাটা আনন্দর বুকে লাগল। যন্ত্রণায় সে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ার আগে হেসে উঠল সারামুখ উজ্জ্বল করে। ও তো জানত না, জমাট বেঁধে যাওয়া রক্তের একটা দানা সেই মুহূর্তে তার ব্রেনের দিকেই ছিটকে যাচ্ছে। ও তখন জানত না, সারা জীবনের জন্য ওর শরীরের বাঁ দিকটা অসাড় হয়ে যাবে। ও জানত না, ডাক্তারবাবু এই ভয়টাই অরুণকে বলেছিলেন।
দোতলার ঘরে নিজের খাটে শুয়ে আছে আনন্দ। বিপিনদা এইমাত্র তাকে পাশ ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। জানলা দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে আকাশটা গাঢ় নীল, সাদা টুকরো মেঘ ইতস্তত ছড়িয়ে অপেক্ষা করছে হাওয়ার। পেলেই ওরা ভেসে বেড়াতে শুরু করবে। আনন্দ অপেক্ষা করছে ওদের ভেসে বেড়ানো দেখার জন্য। বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়ে সে আকাশ, মন্দিরের ধ্বজা আর একটা নারকেল গাছের হঠাৎ বাতাসে দোলা মাথা ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। আর শুনতে পায় শব্দকর্কশ রুক্ষ ধপাধপ দুমদাম মাল ফেলা আর মাল তোলার শব্দ মাঠটা থেকে। মাঠে ছেলেমেয়েরা আর খেলে না। ডগুদা, লেডি সোবার্স আর অমল কোথায় যেন চলে গেছে এই অঞ্চল ছেড়ে।
দিন চারেক আগে সেই পাখির ডাকটা সে অনেকদিন পর শুনতে পেয়েছিল। গভীর রাতে শিসটা লণ্ঠনের মতো দুলতে দুলতে জানলার বাইরে দিয়ে চলে যায়। ভাগ্যিস টেপরেকর্ডারে ধরে রাখেনি? রাখলে, এমন করে অবাক হওয়ার মজাটা ফুরিয়ে যেত।
তন্দ্রা আসছে আনন্দর। চোখের পাতা জুড়ে আসছে ঘুমে। এমন সময় একটা স্বর ফিসফিস করল:
ব্যানার্জি আমি তোমার সঙ্গে ফাইনালে খেলার জন্য অপেক্ষা করছি।
কিন্তু আমি যে কোনর্সের সঙ্গে খেলাটা শেষ করতে পারছি না। ওকে হারাবার পরই তোমার কাছে আমায় তো হার মানতেই হবে, তখন যে আমার খেলাও ফুরিয়ে যাবে। আমি যে অনেকদিন খেলতে চাই।
ব্যানার্জি তুমি আমাকেও হারিয়ো।
না না, তোমাকে আমি হারাতে পারব না।
তুমি হেরে গেলে তোমার দেশের লোক দুঃখ পাবে।
পাক পাক। আমার ইচ্ছেয় আমি হারব আমার ইচ্ছেয় আমি জিতব। আমি একটা দারুণ পৃথিবীতে চলে যাব যেখানে আমায় কেউ হারাতে পারবে না। কিন্তু মুশকিল কী জানো, জিতে ফেললেই সেই পৃথিবীটা থেকে আমায় বেরিয়ে আসতে হবে তাই কোনর্সের কাছে আমি জিতছি না। তুমি কি অধৈর্য হয়ে পড়ছ?
আমি ভয় পাচ্ছি ব্যানার্জি। কোনর্সের সঙ্গে খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তখন তুমি যে ম্যাচ ছেড়ে দেবে।
না, মোটেই না। উইম্বলডন থেকে চলে যাবার পর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। ইন্ডিয়াকে ইনিংস ডিফিট থেকে বাঁচাবার জন্য আমি ব্যাট করব। এখন আমি একশো নট আউট, দুটো দিন ব্যাট করতে হবে। রেকগনাইজড ব্যাটসম্যান বলতে আছে শুধু গাভাসকার। আমি একটার পর একটা রেকর্ড ভাঙতে ভাঙতে যাব। পঞ্চাশ রানে ইন্ডিয়াকে এগিয়ে দিয়ে আউট হব। শেষদিন টি-এর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করতে নামবে আধঘণ্টায় ওই রানটা তুলে নিয়ে ম্যাচ জিততে। কিন্তু ফাস্ট বোলার ব্যানার্জি যে কী জিনিস এইবার ওরা তা দেখতে পাবে, কখনও দেখেনি এমন বোলিং করব।
সেই ম্যাচও তো শেষ হবে একদিন।
হোক। সারা পৃথিবী জুড়ে খেলা চলেছে রোজওয়াল, তুমি কি কাগজ পড়ো না? দ্যাখো না রোজ কত জায়গায় কত খেলা? অফুরন্ত অগুন্তি। আমি এই বিছানায় শুয়ে একটার পর একটা খেলা খেলে যাব। শেষ সুযোগ সব সময় আমার সামনে। থাকবে চিরকাল। সারা পৃথিবী গ্যালারিতে বসে অপেক্ষা করে থাকবে আমাদের ফাইনাল খেলাটার জন্য।