লড়ে যা বাঙালি।
আনন্দ স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে ব্যাট তুলল একবার।
বেঙ্গল টাইগার, কিল দেম।
দিনের লাস্ট ওভারের লাস্ট বলে আনন্দ ঠিক একশোয় পৌঁছল বয়েসকে লেটকাট করে। সোবার্সের মতো ঠিক আশি মিনিট লাগল। লাগত না, দারুণ ফিল্ডিং আর সানির ঠুকঠাক সময় নষ্ট করা। দুবার ফ্ল্যাশ করেছিল অফ স্ট্যাম্পের বাইরে। আনন্দ স্টেডি সানি, স্টেডি বলার পর গাভাসকার আর করেনি।
ইন্ডিয়া সিক্স ফর হান্ড্রেড সিক্সটি। এখনও বাকি দুটো দিন। পুলিশ কর্ডন করে রেখেছে বাউন্ডারি তাই—নয়তো আনন্দ উচ্ছ্বাসের চাপে মারা যেত। হাজার হাজার লোক ঠেলাঠেলি করছে তাকে কিছু বলার জন্য। সব মিলিয়ে একটা বিরাট চিৎকার। লয়েড দাঁড়িয়ে গিয়ে ওকে আগে যেতে দিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের সবাই হাততালি দিচ্ছে। আনন্দ চট করে গেস্ট ব্লকের দিকে তাকাল। মেজদার মুখ গম্ভীর।
বুকের ব্যথার জন্য কেউ জড়িয়ে ধরতে পারল না। সোলকার, বেদি, আবিদ গালে চুমু খেল। ডাক্তারবাবু রাগবে কি না বুঝতে পারছে না।
জানো, পুলিশে খবর দিয়েছে হাসপাতাল থেকে। না বলে তুমি চলে এসেছ।
পুলিশে খবর দেওয়া কেন? হাসপাতালে কি কেউ রিলে শোনে না?
জানো, মারাত্মক কিছু একটা হয়ে যেতে পারে তোমার। তোমার এখন নড়াচড়া পর্যন্ত বারণ।
ইন্ডিয়া হারছে আর আমি শুয়ে থাকব? ব্যানার্জিকে তা হলে চেনেন না। কালও আমি ব্যাট করব।
.
১০.
রাত্রে পাখিটা শিস দিচ্ছিল। বিছানায় উঠে টেবল থেকে টেপরেকর্ডারটা আনার মতো জোর আনন্দর ছিল না। একটু পরেই মেঘ ডেকে ওঠে। বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। দোতলা থেকে অরুণ নেমে এসেছিল। জানলা বন্ধ করে, থার্মোমিটারে জ্বর দ্যাখে।
বাড়িতে তোর ঠিকমতো দেখাশোনা হচ্ছে না। ডাক্তারবাবু বলেছেন হাসপাতালে রাখতে।
কেন?
সেখানে কড়া পাহারায় থাকবি। সেইটাই তোর দরকার।
হাসপাতাল থেকেও তো পালিয়ে বেরোনো যায়। থার্টি টু ব্রিসবেনে এডি পেন্টার হাসপাতাল থেকে এসে ব্যাট করে ইংল্যান্ডকে ছ উইকেটে জিতিয়েছিল। তিরাশি রান করেছিল পেন্টার। গল্পটা তো তুমিই বলেছিল।
অরুণ চলে যাবার পর আনন্দ হেসেছিল। সারাদিনটা সে বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কাটিয়েছে। একবার তার মনে হয়েছিল, এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। এই পৃথিবীতে এমন কী সুন্দর ভাল জিনিস আছে যেজন্য বেঁচে থাকা যায়? আবার তার মনে হয় সারা পৃথিবী সুন্দর আর ভাল জিনিসে ভরে আছে, এই বাড়ির বাইরে বেরোলেই সেই জিনিসগুলোর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে সে মনমরা হয়ে শুয়ে থাকে। বিকেলে ইচ্ছে হয়েছিল দোতলায় যেতে। এতদিনে একবারও ওঠেনি। জানলায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখল দুটো ঘুড়ির লড়ালড়ি। ঘুগনিওলার ডাক শুনে লোভ হয়েছিল, কিন্তু কাছে একটা পয়সা নেই।
সন্ধ্যায় আনন্দ বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে ধরা পড়ল বিপিনদার হাতে।
না, একদম বারণ।
কোনও ওজর, কাকুতিমিনতি বিপিনদার কানে গেল না।
ফটকে সারাক্ষণ তালা দিয়ে রাখতে বলে গেছে মেজবাবু, তা জানো? বাবুর লোকজন সেরেস্তায় আসবে বলে এখন তালা খুলে ফটক পাহারা দিচ্ছি।
আধ ঘণ্টা পর আনন্দ নিঃসাড়ে বাগানের পুব পাঁচিলের ভাঙা নিচু দিকটা টপকাল। মাঠের মধ্য দিয়ে ছুটে বীরা দত্ত রোডে। সেখান থেকে জোরে হেঁটে দেবুদার বাড়িতে। তখন ওর সারা শরীর থরথর কাঁপছে। চিত হয়ে শুয়ে দেবুদা একটা পেপারব্যাক পড়ছিল। বইটা মুখ থেকে ধীরে ধীরে নামিয়ে কয়েক সেকেন্ড স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
কী হয়েছে তোর?
কিছু না। হাঁপিয়ে গেছি।
দেবুদা আবার বইটা মুখের উপর তুলে ধরল।
তোর ডগুদা ছাড়া পেয়ে গেছে।
কী করে?
শিবা দত্ত মামলা তুলে নিয়েছে।
সে কী! ডগুদা রাজি হল?
আনন্দর চোখের সামনে দেবুদা ঘোলাটে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিরাট একটা হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন তার মাথায় এইমাত্র মারল।
কেন রাজি হবে না? দেবুদা বলল।
শুনেছি ওরা বলেছিল জমির মালিকানার ব্যাপারটা যদি চেপে যায়, যদি ডগুদা আর চ্যাঁচামেচি করে ব্যাগড়া না দেয় তা হলে মামলা তুলে নেবে, একটা চাকরিও দেবে। ঠিকই করেছে ডগুদা।
আনন্দর মাথার মধ্যে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার দেখা শোনা বোঝা ধারণাগুলো। যা সত্যি, খাঁটি তার জন্য মানুষ সর্বস্ব ত্যাগ করবে কষ্ট স্বীকার করবে, এটাই সে এতদিন জেনে এসেছে।
আপনিও এই কথা বলছেন?
কেন বলব না? পাড়ার ছেলেরা খেলবে বলে জমি নিয়ে ঝগড়া করা, জেল খাটা, শেষ পর্যন্ত এতে কী লাভ? কই, পাড়ার কোনও লোক তো ওর পাশে এসে দাঁড়াল না? আনন্দ, একটা কথা সবার আগে নিজে বাঁচো তারপর অন্যকে বাঁচাও। ডগুদা তাই করল, বুদ্ধিমান লোক। চিরকাল লোকের উপকার করে বেড়িয়ে এখন বুঝতে পেরেছে এতে কোনও লাভ নেই। আগে নিজের উপকার তারপর অন্যের।
কথা না বলে আনন্দ শুধু দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলেছিল। দেবুদা বইটা আবার মুখের উপর তুলে ধরতেই সে নিঃশব্দে উঠে বেরিয়ে এল। ডগুদার বাড়িতে গিয়ে এখন একবার শুধু জিজ্ঞাসা করবে, কেন সে হার মেনে নিল।
বাড়ির সদর দরজার পাশে খুপরি একটা ঘরে ডগুদা থাকে। রাস্তার উপরেই ঘরের দরজা। বাড়ির ভিতরের সঙ্গে সম্পর্ক একদা ছিল একটা দরজা মারফত। এখন দরজাটা নেই তার জায়গায় দেয়াল উঠেছে। আনন্দ দূর থেকেই দেখল ডগুদার ঘরে হারিকেনের আলো জ্বলছে, দরজাটা আধ ভেজাননা।