মা গেছল কোর্টে। শিবা দত্তর হয়ে সাক্ষী দিল। চাওলা দয়ানিধি, মন্দিরে কাজ করে নেপেন নামে লোকটা, কারখানার লরি ড্রাইভার আর দুটো মজুর। সবাই বলল একই কথা। ডগুদা কারখানায় আগুন লাগাবে বলে শাসিয়েছিল, ওরা শুনেছে। আর আগুন লাগার কিছু আগে ওরা ডগুদাকে কারখানার কাছাকাছি দেখেছে।
ওরা সবাই শিবা দত্তর অনুগ্রহ নিয়ে চলে।
কিন্তু সে কথাটা তো জজকে বলে দেবার মতো কেউ নেই।
ডগুদা বলতে পারে।
মা বলল, ডগুদা নাকি সারাক্ষণ কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ইতস্তত করে অমল আরও কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। আনন্দ তা লক্ষ করে খাট থেকে ঝুঁকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
তোমার বাবা আমার মাকে ডেকে নিয়ে বলেছে, ডগুদা যদি জমিটা নিয়ে চেঁচামেচি আর না করে তা হলে কেস তুলে নেবে আর কারখানায় একটা চাকরিও হবে। মাকে বলেছে ডগুদাকে বুঝিয়ে বলার জন্য।
আনন্দ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে অবশেষে হেসে উঠল।
পাগল, ডগুদা এতে রাজি হবে ভেবেছ? এভাবে ওকে কেনা যাবে না।
তোমার কি শরীর ভাল নেই আনন্দ? হাঁপিয়ে কথা বলছ কেন? চোখ মুখ ফুলো ফুলো!
আবার হাসল আনন্দ।
কোনর্সের সঙ্গে থার্ড সেটের খেলা চলছে ফাইভ গেম অল, ভীষণ টায়ার্ড এখন। রোজওয়াল ফাইনালে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। এদিকে ইন্ডিয়া ফলোতন খেয়েছে।
তুমি বেশি কথা বোলো না।
শুনবে আমি প্রথম ওভারে কী কাণ্ড করেছি?
না। তুমি শুয়ে পড়ো।
ফ্রেডেরিকস আমাকে পিটিয়ে ছাতু করে দিয়েছে। সারা স্টেডিয়াম শুধু ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছে আমাকে। আমি তখন লজ্জায় ভয়ে পালাবার ছুতো খুঁজছি। ওভারের শেষ বলে অসম্ভব একটা ক্যাচ ধরতে গিয়ে বলের ওপর বুক দিয়ে পড়েই দারুণ চোট। হাসপাতালে কেবিনে আছি এখন। বুঝলে অমল, এখন আমি সেই ভেতরের পৃথিবীতে।
আনন্দ চোখ বুজল। নিঃশব্দে জানলা থেকে অমল যে সরে গেল সেটা জানতে পারল না সে। আনন্দ দেখতে পাচ্ছে সে এখন হাসপাতালে। পা টিপে টিপে বেরোচ্ছে কেবিন থেকে। হাতে তোয়ালে মোড়া বুট-জোড়া। লম্বা বারান্দার শেষে সিঁড়ি একতলায় নেমে গেছে। জনমানব নেই কোথাও।
ইন্ডিয়া টি-এ চার উইকেটে পঁয়তাল্লিশ। রেডিয়োটা বন্ধ করেই সাদা জামা আর প্যান্টটা দ্রুত পরে নেয় আনন্দ। নার্স এখন ঘরে নেই। যে-কোনও মুহূর্তে এসে পড়বে। বুট পরে হাঁটলে শব্দ হবে। ওটা লুকিয়ে নিতে হবে। আনন্দ ব্যানার্জি খেলছে, অথচ ইন্ডিয়া হারবে, কী করে তা সম্ভব? বুকে চিড়িক করে উঠল একটা ব্যথা।
সে সিঁড়িতে পৌঁছে লাফিয়ে লাফিয়ে একতলায় এল। বুকের ব্যথাটা জোরে লাগছে। ব্যান্ডেজটা ভাগ্যিস দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বনাথ কি ব্রিজেশের প্যাড, ব্যাট, গ্লাভস চেয়ে নিলেই হবে। আউট হয়ে গেছে ওরা।
ট্যাক্সি, অ্যাই ট্যাক্সি। স্টেডিয়াম চলো, হয়্যার দি টেস্ট ম্যাচ ইজ নাউ বিইং প্লেড। জলদি, কুইক।
ইন্ডিয়া সিক্স ফর ফিফটিওয়ান। তিনদিনেই খেলা শেষ হয়ে যাবে। পতৌদি ফিরে আসছে। ক্লিন বোল্ড বাই রবার্টস। ওর উইকেট এই একটাই। দারুণ স্লো পিচ। রবার্টসের মতো ফাস্ট বোলারও এর থেকে লাইফ পাচ্ছে না। অথচ ইন্ডিয়া কোল্যাপস করে যাচ্ছে। আর রইল কে? ব্যানার্জি তো ব্যাট করবে না। প্রসন্ন, বেদি, চন্দ্র। টি-এর পর ঝপাঝপ গেল আবিদ আর পতৌদি। গাভাসকর চব্বিশ নট আউট।
আর বড়জোর আধঘণ্টা। তারপরই ম্যাচ শেষ। তখন বাসে ওঠা, কি ট্যাক্সি পাওয়া শক্ত হবে। স্টেডিয়াম থেকে এখনই লোক বেরোতে শুরু করেছে।
পতৌদি মাথাটা বাঁ দিকে হেলিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে ফিরছে গ্লাভস খুলতে খুলতে। প্রসন্ন ব্যাট করতে নামবে। তাকে কী বলার জন্য মুখ তুলেই পতৌদি থমকে গেল। বাঁ চোখটা বিস্ময়ে প্রায় কপালে উঠল।
ব্যানার্জি।
ব্যাড লাক, প্যাট।
ওর পাশ দিয়ে আনন্দ এগিয়ে গেল উইকেটের দিকে।
ইনজিওর্ড, তার উপর বোলার, তাই রবার্টস প্রথম বলটা অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে মিডিয়াম-পেসে দিল। সাড়ে চারশো রান হাতে নিয়ে এমন দয়া সবাই দেখাতে পারে।
শব্দ হল টকাস।
স্কোয়্যার কাট। গালিতে গিবস ভয়ে উবু হয়ে বসে পড়ল। বলটা দেখা গেল না বাউন্ডারিতে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত।
সোবার্স হাসল হাততালি দিতে দিতে। কালীচরণও দিল। ওরা জানে, হারের মুখে ব্যাট করতে এসে এরকম দু-চারটে বেপরোয়া মার সবাই মারে।
নেক্সট বলটা সোজা। টক। বোলারের ওপর দিয়ে ছয়। ওভার শেষ। গাভাসকার এগিয়ে এল কথা বলতে।
ইউ জাস্ট স্টে দেয়ার সানি। ওনলি স্টে অ্যান্ড গিভ মি সাপোর্ট। ডোন্ট টেক শর্ট রানস বিকজ—
আনন্দ বুকে হাত দিয়ে, ইংরেজিতে কথাগুলো অনুবাদ করতে না পেরে শুধু বলল, পেন।
অবাক চোখে তাকাতে তাকাতে গাভাসকার ক্রিজে ফিরে গেল।
পনেরো মিনিটের মধ্যে লয়েডকে ফিল্ড ছড়িয়ে দিতে হল। রবার্টসের এক ওভারে কুড়ি রান। একটা সিঙ্গল নিতে পারত, নিল না। বুকে যন্ত্রণা। গিবসের এক ওভারে ছাব্বিশ, তিনটে ছয়ই স্ক্রিনের ওপর। সোবার্স এক ওভারে দিল যোলো। কভারে জলপোকার মতো ছোটাছুটি করছে বয়েস। গোয়েন্দাদের মতো থার্ডম্যানে লরেন্স রো পায়চারি করছে। নেমন্তন্ন বাড়িতে খাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকা বরযাত্রীর মতো উশখুশ করছে কানহাই, স্লিপে।
বন্যার মতো রানের স্রোত চলেছে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। ডুবে গেল কালীচরণের ইনিংস। সোবার্সের ইনিংস, কানহাইয়ের ইনিংস। বোম্বাইয়ের হাজার হাজার বাঙালি থাকে। নিশ্চয় তারা খেলা দেখতে এসেছে।