টেনিস কোচ, অন্য কোর্টে ফোরহ্যান্ডে ব্যস্ত ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। উচিত হবে না, আনন্দ নিজেকে ধমক দিল, নিশ্চয় কোচের নজরে পড়বে, শুধরেও দেবে। তবু অস্বস্তি হচ্ছে। চমৎকার স্বাস্থ্য, প্রায় তার সমানই লম্বা, অথচ কী মিনমিনে সার্ভিস।
আনন্দ বেঞ্চে বসে ডান দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখে পড়েনি বাঁ দিকের কোর্ট থেকে একটা বল বেঞ্চের দিকে ছিটকে এল। একজন চেঁচিয়ে বলটা ছুড়ে দেবার জন্য বলতেই সে মুখ ফিরিয়ে দেখল তার পিছনে হাত পাঁচেক দূরে পর্দার নীচেই বলটা। শিথিল দেহটাকে বেঞ্চ থেকে তুলে দাঁড় করাবার আগেই আনন্দ দেখল, বেঞ্চের পিছন থেকে শিম্পাজির মতো দুলতে দুলতে ছুটে গেল বলের দিকে এবং বলটা কুড়িয়ে কোর্টে ছুড়ে দিল সেই ছেলেটি, যাকে সে তাদের পাড়ার রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখে।
নিঃশব্দে কখন যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল আনন্দ টের পায়নি। মাথা ভরা রুক্ষ চুল, জ্বলজ্বলে চোখ, গায়ে আধময়লা লাল কালো চিজ কটনের শার্ট। গায়ের চামড়া খসখসে, পালিশচটা কাঠের মতো বিবর্ণ। ওর কাঁধ থেকে দেহটি কোমর পর্যন্ত ঝোঁকানো থাকে সর্বদা, যেহেতু ডান-পা পোলিওয় শীর্ণ সেহেতু বাম উরুতে হাত রেখে বাঁ দিকে ওকে ঝুঁকে থাকতে হয়। পা টেনে দুলে দুলে হাঁটে। বাঁ পা-টি ডান পায়ের থেকে একটু পুষ্ট। দুটি পা-কে মনে হয়, একটি তল্লা বাঁশ আর একটি কঞ্চি যেন মাটি থেকে উঠে নীল হাফ প্যান্টের মধ্যে ঢুকে গেছে। পায়ে নীল রঙের ধুলোভরা কেডস। ঠোঁট চেপে, শুধু দুটো চোখের মধ্য দিয়ে হাসছে কোর্টের দিকে তাকিয়ে। বয়স হয়েছে, অন্তত আনন্দের থেকে চার-পাঁচ বছরের বড়ই হবে। চোখের কোণে, ঠোঁটের কোলে বয়স লুকিয়ে আছে।
মস্ত বড় কাজ করেছে। বিরক্ত অপ্রতিভ আনন্দ আবার বেঞ্চে বসল। বলটা আমারই ছুড়ে দেওয়ার কথা, ওস্তাদি দেখাল আর কী। যেন ও ছাড়া আর কেউ কাজটা পারত না।
আনন্দ আবার তাকাল ওর দিকে, ওর পায়ের দিকে। অদ্ভুত অমানবিক ভঙ্গিতে দাঁড়ানো এবং দৌড়নোর দৃশ্যটা তার মনে কয়েকবার ভেসে উঠল। যে দেখবে তারই করুণা হবে। এই করুণা নিয়ে ওকে আজীবন কাটাতে হবে। হয়তো ও দারুণ গাইয়ে হবে, পণ্ডিত হবে, কবি হবে বা দারুণ ছবি-আঁকিয়ে হবে, কিন্তু আজীবন ওকে দেখেই সম্রম বা ভালবাসার আগে লোকের মনে প্রথমেই জাগবে করুণা। কী বিশ্রী ব্যাপারটা, আনন্দ ভাবল, মানুষের শরীর নিয়ে কী জঘন্য আমাদের ধারণা। এটাই যেন জীবনের একমাত্র জিনিস। শরীরের আড়ালেই তো আসলে জিনিসটা—মন, বুদ্ধি। তবু চেহারাটাই লোকে আগে চায়। চোখ সবার আগে যা দেখে তাই দিয়ে প্রথমেই ধারণা তৈরি করে দেয়। মন দিয়ে কি প্রথমেই দেখা যায় না? এবার মায়া হল তার। খেলা করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। কোনও খেলাই নয়। বেচারা! ক্ষমতা নেই, অথচ দেখে মনে হচ্ছে, খেলার খুব ইচ্ছে। কী ভীষণ ওর কষ্ট হয়, যখন অন্যদের খেলতে দেখে! আর-একটা টেনিস বল কোর্ট থেকে বেরিয়ে এল সোজা তার দিকেই। আনন্দ একটু ঝুঁকে ফিল্ড করতে পারত, করল না। বলটা বেঞ্চের তলায় গিয়ে পর্দায় লাগল।
অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে অপেক্ষা করছে আনন্দ। ছুটে আসুক। বলটা কুড়িয়ে ছুড়ে দিক কোর্টে।
আসছে না। তাকাল সে। বাম উরুতে হাত রেখে কোমরটা বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হল। আনন্দর মনে হল ও যেন চোখ দিয়ে জিজ্ঞেস করছে: তুমি নিজে ছুড়ে দেবে? যদি না দাও, তাহলে আমি ছুড়ব। দেবে ছুড়তে?
আনন্দ মাথা হেলাল।
চোখ দুটি উজ্জ্বল করে তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে ও হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। আনন্দ লাফিয়ে উঠে ছুটে গিয়ে ওকে মাটি থেকে তুলল। কী হালকা, জিরজিরে শরীর। লজ্জা ঢাকতে আনন্দর মুঠো থেকে বাহু দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে, লাগেনি, আমার লাগেনি বলতে বলতে তাড়াতাড়ি বলটা কুড়োবার জন্য এগিয়ে গেল।
আন্দ, তুই এখানে! যা ভেবেছি। বাড়ি যাবি না কি?।
আনন্দ টেনিস ক্লাবের গেটের দিকে হাত তুলে বন্ধুদের অপেক্ষা করতে বলে, কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি খুব খেলতে ইচ্ছে করে?
ও প্রথমে না শোনার ভান করল। আনন্দ আবার জিজ্ঞাসা করতে চাপা ঝাঁঝ নিয়ে বলল, আমি খেলি।
মুখটা এত কঠিন করে ও কোর্টের দিকে তাকিয়ে থাকল যে, আনন্দ ভরসা পেল না জিজ্ঞাসা করতে, কী খেলা খেলো? অভিজ্ঞ পোড়-খাওয়া বয়স্ক লোকের মতো এখন ওর মুখটাকে দেখাচ্ছে। আনন্দর মনে হল, ও অনেক কিছু জানে বোঝে ভাবে।
.
নেতাজি পার্ক থেকে বাড়ি হেঁটে কুড়ি মিনিটের পথ। ফেরার পথে আনন্দ বন্ধুদের জানাল, টেনিস সার্ভিস এবং ফাস্ট বোলিং ব্যাপার দুটো একই জিনিস। শুধু তাই নয়, সেটা বোঝাবার জন্য হাতের কিটব্যাগটা নামিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। একটা ঢিল কুড়িয়ে খানিকটা ছুটে ডেলিভারি দিল।
এবার সার্ভিসটা দেখা।
আনন্দর মনে হচ্ছে, আবার শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে ধকল দিলে আবার সে শ্বাসকষ্টে পড়বে। বন্ধুরা কৌতূহলে তাকিয়ে। আনন্দ ভাবল, একটা সার্ভিস তো। কতটুকুই বা কষ্ট হবে।
আনন্দ সার্ভিস করল কাল্পনিক র্যাকেট ও বল নিয়ে। বন্ধুরা গভীরভাবে লক্ষ করল। একজন বলল, তফাত আছে। একটা ছুটে এসে ডেলিভারি, অন্যটা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে।
তা হলেও, আনন্দ তর্ক শুরু করল। মূল ব্যাপারটা একই। বল ডেলিভারি আর সার্ভিসের একটা সময়ে শরীরের সবকিছু একই নিয়মে চলে।