কোথায় পাব? ডগুদার বাড়ির কেউ একটা পয়সাও দিতে রাজি নয়।
তাহলেই বোঝ কী রকম লোক। জেল খাটুক অভিজ্ঞতা হবে।
আনন্দ যাবার আগে শুধু বলল, মেইগ্রে পড়ে আপনি কিছু বোঝেননি?
সন্ধ্যা উতরে রাত শুরু হয়ে গেছে। এতক্ষণ বাইরে থাকার অনুমতি তার নেই। দেবুদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আনন্দ জোরে হাঁটতে শুরু করল। পর পর কদিন রাতে বৃষ্টি হয়েছে। বাতাস জোলো। দেবুদা কাল তাহলে অ্যাপিয়ার হবে না। অন্ধকার খেলার মাঠটার মধ্য দিয়ে যাবার সময় একটা ইট পায়ে লাগতেই অভ্যাসবশত কুড়িয়ে নিল। সাইজটা ক্রিকেট বলের। নিশপিশ করে উঠল ওর ভিতরের রাগ আর দুঃখের মতোই কাঁধের পেশিগুলো। তিন আঙুলে ইটটাকে ধরে সে ছুটতে ছুটতে লাফিয়ে উঠে বল করার মতো ছুড়ল কারখানার দেয়ালে।
দেয়ালে ইট লাগার শব্দটা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ডান হাতে সে বুক চেপে ধরল। মনে পড়ল তার বুকে চোট। এট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন নয়, ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ফ্রেডেরিকসের ক্যাচ ধরতে গিয়ে বলের উপর বুক দিয়ে পড়েছে। এখন সে বোম্বাইয়ে।
বুকে হেভি ব্যান্ডেজ। ডাক্তার বলেছে শুয়ে থাকতে। পুরো রেস্ট। কাল মাঠ থেকেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। এক্স-রে হয়েছে। পাঁজরার হাড়ে ক্র্যাক দেখা গেছে। কেবিনে রাখা হয়েছে।
ট্রানজিস্টারে কান পেতে আনন্দ শুয়ে। সেকেন্ড-ডে লাঞ্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টু ফর ফোর হানড্রেড সেভেনটি। দু উইকেটে চারশো সত্তর। কালীচরণ ব্যাটিং দুশো চার, কানহাই ব্যাটিং হানড্রেড ফিফটি। ফ্রেডেরিকস সত্তর, আর একজন পনেরো, বাকিটা এক্সট্রা।
আউট!
লাঞ্চের পর প্রসন্নর প্রথম বলেই কালীচরণ শর্টলেগে সোলকারের হাতে!
কে আসছে? লরেন্স রো! রিলেওলারা কী যে বলে। আনন্দ কানের কাছে সেটটা ধরল ঠিক মেজদার মতো। (ওহ, কাল মেজদাও হাসপাতালে এসেছিল, আজ সকালেও। ইন্ডিয়া টিমেরও সবাই এসেছিল।)।
সোবার্স। আশ্চর্য, সোবার্সকে দেখে চিনতে পারে না? পতৌদি অ্যাটাকিং ফিল্ড সাজিয়েছে। নিউ ব্যাটসম্যান।
কানহাই-সোবার্স। তিন উইকেটে চারশো সত্তর। আর কতক্ষণ ব্যাট করবে? টি-এ ডিক্লেয়ার করা উচিত। সোবার্স পনেরো মিনিটে মারল প্রথম চার, বেদিকে। নেক্সট পনেরো মিনিটে তিরিশ। আশি মিনিটে একশো এক। কানহাই ততক্ষণে মাত্র বারো।
লয়েড ডিক্লেয়ার করল। লাঞ্চের পর একশো মিনিট ব্যাট করেই। সাড়ে পাঁচশো মিনিটে থ্রি ফর সিক্স হান্ড্রেড টোয়েন্টি। টি-এর আগে দশমিনিট ইন্ডিয়াকে ব্যাট করতে দিয়ে কী এমন লাভ হবে!
অন্ধকার মাঠের ওপর দিয়ে কয়েকটা লোক কথা বলতে বলতে চলেছে আনন্দদের বাড়ির দিকে। মাঠের উপর বিকেলে কয়েকটা ড্রাম নামিয়ে রেখে গেছে কারখানার লরি। আনন্দ এতক্ষণ তারই একটার উপর বসে। লোকেদের কথার শব্দে বোম্বাই টেস্টম্যাচ থেকে সে মুহুর্তে ফিরে এল বাস্তবে।
আনন্দ ওদের পিছু পিছু বাড়ির দিকে এগোল। মাথা ভার ভার লাগছে, গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা।
উকিলবাবু যা যা শিখিয়ে দেবে, মুখস্থ করে ফেলবি। ঠিক সেইভাবে বলবি।
কথা বলতে বলতে ফটক পেরিয়ে ওরা ঢুকছে। আনন্দ দেখল দুটি অল্পবয়সী ছেলে আর শিবা দত্তর ম্যানেজার।
বিপিনদা সিং-দরজার কাছে উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে; আনন্দকে দেখা মাত্র ফেটে পড়তে গিয়েও পড়ল না।
এ কী চোখমুখের অবস্থা হয়েছে। গা পুড়ে যাচ্ছে যে!
বিপিনদা, আমাকে ঘরে নিয়ে চলো।
এইটুকু বলেই আনন্দ বিপিনদার বাহু আঁকড়ে হাঁপাতে লাগল।
কী যে এক অসুখ, চিকিচ্ছেও কিছু নেই। সন্ধে থেকে আমি খোঁজাখুঁজি করছি। মেজবাবু জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না।
আনন্দ সারারাত জ্বরের ঘোরের মধ্যে কাটাল। এক একবার চমকে উঠে কান পেতেছে কিছু একটা শোনার জন্য। আবার আচ্ছন্ন হয়েছে। একবার তার মনে হল, কে যেন মাথায় হাত বুলোচ্ছে।
কে?
রোজওয়াল।
উইম্বলডন পেয়েছ?
এখনও তো কোনর্সের সঙ্গে তোমার সেমি ফাইনাল খেলা শেষ হয়নি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক। বাকি আছে বটে।
তুমি সেরে উঠলে হবে?
আনন্দ মাথা কাত করল।
.
সকালে অরুণ গম্ভীর হয়ে গেল ওকে দেখার পর।
ডাক্তারবাবু যা বারণ করেছিলেন, তুমি তা-ই কিন্তু করেছ। এই অসুখে সাবধানতাই কিন্তু একমাত্র চিকিৎসা, তোমায় তা বার বার বলা হয়েছিল।
আর কিছু সে বলেনি। দুপুরে আনন্দ ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে একবার ঘুরে এল।
ইন্ডিয়া অল আউট একশো পঁয়ত্রিশ তৃতীয় দিন লাঞ্চে। ফলোঅন। চারশো পঁচাশি রান পিছনে। খেলা এখনও আড়াই দিন বাকি। হার হার, আবার ইনিংস ডিফিট। উইকেটে লাইফ নেই, অ্যান্ডি একটাও উইকেট পায়নি। সোবার্স গুগলিতে দুটো, গিবস ছটা, দুটো রান আউট।
হাসপাতালের কেবিনে আনন্দর কানে রেডিয়ো। স্টেডিয়ামের হট্টগোলের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। যেন শ্মশানে খেলা হচ্ছে।
বিকেলে আনন্দর জ্বর কমে সন্ধ্যায় আবার বাড়ল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কবজিতে, কনুইয়ে, হাঁটুতে, পায়ের গোছে কেউ যেন হাড়গুলো চিবোচ্ছে। যন্ত্রণায়। ঝনঝন করছে শরীর। কিন্তু বকুনির ভয়ে বলল না। সে যে খুব বেশি কাহিল নয়, এটা প্রমাণ করার জন্য বিপিনদা যা দিল, তা-ই খেয়ে ফেলল। বার বার উত্তরের জানলায়। তাকাল অমলের জন্য। ডগুদার মামলার খবর তাকে জানতেই হবে।
পরদিন দুপুরে অমল এল।
কী হল?