তোমার বাবা ওদের উকিল দাঁড়িয়েছে।
আনন্দর মুখ মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হল। চোখে ফুটল অসহায়তা।
আমি কী করতে পারি।
না না, এমনিই বললাম, আমি এখন চলি।
আনন্দ কিছু বলার আগেই জানলা থেকে অমল অদৃশ্য।
বিপিনদা ঘরে ঢুকল। তাকে ট্যাবলেট খাইয়ে চলে গেল।
আমি কী করতে পারি! আনন্দ ভাবতে শুরু করল ঘরে পায়চারি করতে করতে। ডগুদা পরের উপকার করার জন্য সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। একটা আদর্শ আছে, আদর্শবাদী লোক। তাই বিয়ে পর্যন্ত করেনি। সেকালে বিপ্লবীরাও নাকি এইরকম ছিলেন, দেবুদাই বলেছিলেন বিপ্লবীরা সংসারী হতেন না দেশের সেবা করার জন্য। ডগুদা সম্পর্কে বলেছিলেন, ইডিয়ট, লেখাপড়া করেনি, বুদ্ধিশুদ্ধি নেই, আছে শুধু গোঁয়ার্তুমি আর সারল্য। জীবনে এরাই পস্তায়। ডগুদা পরোপকার করতে গিয়ে এখন পস্তাচ্ছে। দেবুদা শুনে নিশ্চয় খুশি হবে। হঠাৎ আনন্দর মনে ভেসে উঠল একটি মুখ। পুরুলেন্সের চশমা, লম্বাটে চোয়াল, বিরাট একটা মাথা—দেবুদার মুখ। আশ্চর্য! আনন্দ মনে মনে বলল পায়চারি থামিয়ে, আশ্চর্য এতক্ষণ এটা কেন মনে আসেনি। দেবুদা তো উকিল, সেই তো ডগুদার জন্য মামলা লড়তে পারে। ছাড়িয়ে আনার জন্য প্যাঁচালো যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বড় উকিল হবার এই তো সুযোগ দেবুদার সামনে। ফি নিশ্চয়ই চাইবে না, ব্রিফলেস উকিলকে সেধে মামলা দিলে বর্তে যাবে। মামলায় জিতলে বেকসুর ডগুদাকে খালাস করতে পারলে দেবুদার নাম হবে। তখন লাইন পড়ে যাবে ওর বাড়িতে। এটা ওর মাথায় ঢোকাতে যদি পারা যায়।
.
০৯.
তোর বাবা তো শুধু বোঝে আইন। আর, শুধু আইন মুখস্থ থাকলেই কি উকিল হওয়া যায়?
ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দেবুদা কপালে তিনটে টোকা দিল।
নিশ্চয়, ব্রেনই তো আসল জিনিস। স্কুলমাস্টার কি ঔপন্যাসিক কি ডিটেকটিভের মতো উকিলেরও দরকার ব্রেন। মেইগ্রের ব্রেন আছে বলেই তো—
আনন্দ ইচ্ছে করেই শেষ করল না। তক্তপোশে আধশোওয়া দেবুদা মুচকি মুচকি হাসছে। মেজাজটা মনে হচ্ছে ভালই রয়েছে।
তা হলে ডগুদার কেসটা কী হবে?
আরে দূর, এসব ছোটখাটো ব্যাপারে আমাকে টানাটানি কেন।
ছোটখাটো! একটা লোক বিনা দোষে জেল খাটবে, ষড়যন্ত্রের শিকার হবে, আর একে ছোটখাটো বলছেন? ধরুন একটা লোককে মিছিমিছি খুনের সঙ্গে জড়িয়ে অকাট্য সব প্রমাণ রেখে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হল। ধরুন না মেইগ্রের সেই কেসটা যেটা একদিন বলেছিলেন আমাকে।
দেবুদা ভ্রূ কুঁচকে বলল, কোনটা?
সেই যে গ্রামের খিটখিটে ঝগড়ুটে বুড়িটাকে একদিন তার ঘরে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল। এয়ার রাইফেলের গুলিতে মরেছে। সবাই সন্দেহ করল গ্রামের পাঠশালার মাস্টারকে। তার সঙ্গে বুড়ির প্রায়ই ঝগড়া হত। মাস্টার বাইরে থেকে এসেছে, গ্রামের লোকেরা তার শহুরে হাবভাব ভাল চোখে দেখত না, তাই তাকে ভীষণ অপছন্দ করত। গ্রামের পুলিশও মাস্টারকে সন্দেহ করছে। মাস্টারের ছেলের এয়ার রাইফেল আছে, অবশ্য অন্য বাড়িতেও আছে। তা ছাড়া মাস্টারের বাড়ি থেকে বুড়ির ঘরটা দেখা যায়। মাস্টার ভয়ে ছুটে এল প্যারিসে মেইগ্রের কাছে আকুল আবেদন নিয়ে আমাকে বাঁচান। মেইগ্রে তখন কী করল?
জানি।
বলতে পারত তো আমাকে আবার টানাটানি কেন? আমি শহরের পুলিশ, গ্রামের পুলিশের এলাকায় নাক গলাবার অধিকার নেই। কিন্তু গ্রামে গেল তো সে মাস্টারের সঙ্গে! লোকটার উপর কি শুধু মায়াই পড়ে গেছল? মানবিকতা বলে একটা ব্যাপারও তো আছে।
তুই তো বেশ গালভরা পাকাপাকা কথা শিখেছিস। উকিল হবি নাকি বাবার মতো!।
দেবুদা, আমার কিন্তু স্থির বিশ্বাস, ডগুদার কেসটা পেলে মেইগ্রে ঠিক নিয়ে নিত। বুদ্ধির ব্যাপার আছে যে!
উঠে বসল দেবুদা। চশমাটা পাঞ্জাবির খোঁটায় মুছে চোখে লাগিয়ে পিটপিট করে তাকাল।
কী বুদ্ধির ব্যাপার?
তা আমি কী করে জানব! একটা নিরপরাধ লোককে প্যাঁচে ফেলা হয়েছে, তাকে ছাড়িয়ে আনতে নিশ্চয় বুদ্ধি লাগবে। সাক্ষীদের জেরা করে, কি তাদের প্রমাণগুলো মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, কি ডগুদা তখন অন্য জায়গায় ছিল এইরকম কিছু প্রমাণ দিয়ে প্যাঁচটাকে খুলে ফেলতে হবে। মেইগ্রে হলে ঠিক পারত।
দেবুদা ডান তালু দাড়িতে ঘষতে ঘষতে আড়চোখে কয়েকবার আনন্দর মুখের দিকে তাকাল।
তবে মুশকিল কী জানেন দেবুদা, বাবার সঙ্গে আপনি পারবেন কি না তাই নিয়ে আমার বেশ—
আনন্দ টেবলে টাইমপিসটার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। দেবুদার গাল ঘষা বন্ধ হয়ে গেছে।
কালকেই কেস আছে বললি। খরচ-টরচ দেবে কে?
মেইগ্রে তো নিজের খরচেই মাস্টারের সঙ্গে গ্রামে গিয়েছিল। নিজের খরচেই হোটেলে ছিল।
তাই বলে আমাকেও কি পকেট থেকে টাকা বার করতে হবে? একটা পয়সাও আমি খরচ করতে পারব না।
দমে গেল আনন্দ। দেবুদা রাজি হয়েও পিছিয়ে যাচ্ছে। বেচারা ডগুদা, বিনা দোষে জেল খাটবে। মিথ্যে মামলার ফাঁস থেকে ওকে বার করে আর কে আনতে পারে। শুকনো মুখে আনন্দ বলল, ডগুদা ওই মাঠটাকে পাড়ার ছেলেদের খেলার জন্য বুক। দিয়ে আগলে রাখে, শিবা দত্তর লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে, মাঠটার দলিলে কী লেখা আছে ডগুদা তা জানে, ওর জন্যই মাঠটাকে ওরা গ্রাস করতে পারছে না। একটা ভাল লোক অযথা জেলে যাবে আর আমরা কিছু করব না?
করতে গেলে টাকা লাগে।