প্লে।
আম্পায়ার রুবেন্স পাশে তুলে রাখা বাঁ হাতটা নামিয়ে ঝুঁকে পড়ল।
আনন্দ একবুক নিশ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করল। তারপর ছুটতে শুরু করল বল হাতে। পঞ্চাশ হাজার লোকে ভরা স্টেডিয়াম শাসরুদ্ধ কৌতূহলের চাপে বোবা হয়ে গেল মুহূর্তে। এই সেই বোলার, যে একটাও ফাস্ট ক্লাস ম্যাচ না খেলেই টেস্ট খেলছে। সিলেক্টাররা ওর মধ্যে কী দেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে নামিয়েছে? অবশ্য প্রথম চারটি টেস্টেই হেভি ইনিংস ডিফিটের পর আর একটা ডিফিটে কিছু এসে যায় না। তা হলেও সালগাঁওকর ছিল, মহীন্দর অমরনাথ ছিল, ঘাউড়ি ছিল। তা নয়, কোথাকার এক বোলার, বেঙ্গলেও যাকে কেউ চেনে না, একে টেস্ট খেলাবার। কোনও মানে হয়?
ওরা উদগ্রীব হয়। কে এই ব্যানার্জি! কেমন বল করে, কত জোরে করে!
ব্যাটের ঠিক মাঝখানে বল মারার মিষ্টি একটা শব্দ। লেগ স্টাম্পে ফুলটস। ল্যাটা ফ্রেডেরিকস এক জায়গায় দাঁড়িয়েই অন-ড্রাইভ করেছে। স্কোয়ার-লেগ থেকে ব্রিজেশ প্যাটেল নিয়মরক্ষার জন্য কয়েক পা ছুটে থেমে গেল। একটা পুলিশ বাউন্ডারি থেকে বলটা ছুড়ে দিল।
প্রথম বলে চার। আনন্দর কান দুটো গরম হয়ে উঠল। রাতে একবার ভেবেছিল, প্রথম বলেই স্টাম্প ছিটকে দিয়ে মাঠে হইচই ফেলে দেবে। এঞ্জিনিয়ার ফাস্ট স্লিপ বিশ্বনাথকে কী যেন বলল। বিশ্বনাথ মাথা নাড়তে নাড়তে পাশের গাভাসকরের দিকে তাকিয়ে হাসল।
দ্বিতীয় বল। বলটা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দর বুক হিম হয়ে গেল। ইন সুইংটা এত বড় হয়ে যাবে ভাবেনি। তাও শর্ট পিচ। মাঁকড় ভয়ে মাথা নিচু করল। স্কোয়ার কাটের শব্দটা চাবুকের মতো আনন্দর মুখে আছড়ে পড়ল। কভার থেকে পতৌদি হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল পয়েন্ট বাউন্ডারির দিকে, মাঠের মধ্যে ছুড়ে দেওয়া বলটা আনতে। বলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আনন্দর দিকে ছুড়ে দিল।
তৃতীয় বল।
হাঁটুটা কাঁপছে। কাঁধে যেন একশো কেজির চালের বস্তা চাপাননা। লেংথ আর ডিরেকশন এবার এ দুটো যেন ঠিক থাকে। স্রেফ সোজা বল। সুইং টুইংয়ে ওস্তাদি নয়। একটু শুধু ঠুকে দেওয়া।
সপাটে পুল। চার। এতটা শর্টপিচ হয়ে যাবে আনন্দ ভাবেনি।
বলটা পতৌদি কাছে এসে হাতে দেবার সময় বলল, ঘাবড়ো মাৎ।
মাথা নিচু করে বোলিং মার্কে ফিরে এল আনন্দ। পিছন থেকে একটা চিৎকার এল—গুড বোলিং ফর লেডিজ ক্রিকেট।
দরদর ঘামছে আনন্দ। প্যান্টে হাত মুছল। একটা বাউনসার দিলে কেমন হয়? যদি ব্রিজেশের কাছে ক্যাচ ওঠে।
না হুক, না পুল ধরনের একটা শট। ফাঁকা মিড উইকেট দিয়ে বলটা বাউন্ডারিতে গেল। চার বলে যোলো রান। চারদিকে বেশ শোরগোল। আনন্দ কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কিছু বুঝতে পাচ্ছে না। লজ্জায় অন্ধ হয়ে গেছে, কালা হয়ে গেছে। এখন কোনওরকমে মাঠ থেকে পালানো যায় যদি।
কিপ দ্য বল ওয়েল আউটসাইড দ্য লেগ স্টাম্প।
পতৌদির গলাটা কেমন কঠিন। আনন্দ মাথা নাড়ল।
ফিফথ বল। রুবেন্স দুহাত মেলে ধরল। ওয়াইড বল।
সবাই বুঝে গেছে ব্যানার্জি নার্ভাস হয়ে পড়েছে। পালাবার একমাত্র উপায় ইনজিওর্ড হয়ে যাওয়া। পা মুচকে? টেরিফিক শট আটকাতে গিয়ে আঙুল ভেঙে? বল ধরতে ঝাঁপিয়ে কাঁধের হাড়ের ডিসলোকেশন?
পরেরটা হল নোবল, ফ্রেডেরিকস হাঁকড়েছে। আনন্দর মাথার উপর দিয়ে ছয় হতে হতেও হল না। বাউন্ডারির হাত খানেক ভিতরে পড়েছে।
আরও দুটো বল করতে হবে। ছ বলে একুশ রান হয়েছে। ফ্রেডেরিকসের কুড়ি, একটা ওয়াইড, এবার পালাতে হবে। মাসল পুল তো হতে পারে! ফাস্ট ওভারেই কি হওয়াটা উচিত হবে? লোকে ঠিক ধরে ফেলবেব্যাটা মার খেয়ে পালাচ্ছে।
এবার লেংথে সোজা বল, একটু স্লো। ফ্রেডেরিকস এবারও মারের বল পাবে ভেবেছিল। পা বাড়িয়ে ড্রাইভ করার জন্য ব্যাট তুলে যখন বুঝল বলটা মারলে উঠে যাবে তখন ব্যস্ত হয়ে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলতেই বলটা সামনে একটু উঠে গেল। আনন্দ হাত বাড়িয়ে ঝাঁপাল।
আর উঠছে না সে। ছুটে এল সবাই। বলটা মাটিতে পড়েছে, তার উপর পড়েছে ওর বুক। শরীরের চাপে বলটা পাঁজরে, ঠিক যেখানে হার্ট সঙ্গে সঙ্গে সেন্সলেস।
.
আনন্দ, আনন্দ।
চোখ বুজে আনন্দ হাঁপাচ্ছে। বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানিটা কী রকম অদ্ভুত একটা ব্যথা তৈরি করেছে। একগোছা তীক্ষ ছুঁচ যেন পর পর বিধিয়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস নিতে গেলে লাগছে।
আনন্দ?
চোখ খুলে তাকাল। জানলার বাইরে অমল।
শুনেছ, ডগুদাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
কেন, কবে, কী করেছে?
কারখানায় সেদিন যে আগুন লেগেছিল, ওটা নাকি ডগুদার কাজ। পুলিশের কাছে ওরা নালিশ করেছিল তাই ওকে ধরে নিয়ে গেছে, কোর্টে কেসও উঠেছে।
এত ব্যাপার হয়ে গেল, আর আমি কিছুই জানি না! ডগুদা কোথায়?
জেলে।
জামিন দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়নি?
কে জামিন দাঁড়াবে? ওর ভাইয়েরা বলেছে, আমরা কিছু পারব টারব না। মা চেয়েছিল জামিন হতে, কিন্তু আমাদের তো টাকা বা বিষয়-সম্পত্তি কিছুই নেই।
ডগুদা আগুন লাগিয়েছে, হতেই পারে না। মিথ্যে কথা। কে দেখেছে?
দু-তিনজন ডগুদাকে নাকি কারখানার পিছনে যেদিকে আগুন লাগে, সেদিক থেকে আসতে দেখেছে। কালকেই মামলা উঠবে। এছাড়াও ডগুদা নিজেই তো একদিন চিৎকার করে বলেছিল আগুন লাগিয়ে দোব।
রাগের মাথায় ওরকম কথা সবাই বলে। তার মানে এই নয় যে, সত্যি সত্যিই আগুন দেবে। মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। আমি শিওর। এই মাঠটাই হচ্ছে সবকিছুর মূলে, শিবা দত্ত এটাকে গ্রাস করতে চায়। ডগুদাই হচ্ছে কাঁটা।