আনন্দ ছটফট করে বিছানার এধার থেকে ওধার গড়াগড়ি দিল।
কিছু একটা ইন্ডিয়াকে দোব। একটা, একবার, শেষ সুযোগের সামনে একবার…
ছটফট করতে করতে আনন্দ একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। ঘণ্টা দুয়েক গভীর ঘুমের পর আপনা থেকেই সে জেগে উঠল। উত্তরের জানলা দিয়ে আকাশে চোখ মেলে দেখল, ঘন মেঘে ছেয়ে রয়েছে। ঘুমোবার আগে ছিল গনগনে রোদ। বহু দূরে দমদমে নামার জন্য একটা জেট প্লেন নিচু হচ্ছে। তার হঠাৎ মনে পড়ল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট টিম এবার আসবে। ইংল্যান্ডে সদ্য থেঁতলে যাওয়া ভারতকে এবার ওরা মাড়িয়ে যাবে কারা কারা আসবে টিমে?
এখনও টিমের নাম অ্যানাউন্স করেনি। শুধু করেছে ক্যাপ্টেনের নাম, লয়েড। সোবার্স বলেছে, আমি রিটায়ার করিনি, তার মানে আসতেও পারে। কানহাইও। কালীচরণ, রো, ফ্রেডেরিকস, বয়েস, মারে, হোল্ডার, গিবস, এরা তো আসবেই। আর অ্যান্ডি রবার্টস। উফফ, কী টিম! এদের এগেনস্টে বোলিং!
চকচক করে উঠল আনন্দর চোখ। তছনছ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ভারতকে। মুহ্যমান লোকেরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে রিলে শুনছে আর হতাশায় মাথা নাড়ছে—এমন একটা দৃশ্য চোখের ওপর ভেসে উঠতেই টেপরেকর্ডারটা চালিয়ে, সেটা বুকের কাছে ধরে সে ফিসফিস বলতে লাগল: আকাশবাণী, এখন খবর পড়ছি ইভা নাগ। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল, বোম্বাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পঞ্চম ও শেষ টেস্ট খেলার জন্য ভারতীয় দলের নাম ঘোষিত হয়েছে। বাংলার ফাস্ট বোলার আনন্দ ব্যানার্জি চোদ্দোজনের মধ্যে স্থান পেয়েছেন।
সারা বিকেল সে এই কথাগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে শুনল।
.
০৮.
ব্যানার্জি তুমি খেলছ!
এতক্ষণ কাঠ হয়ে বসে ছিল আনন্দ, ড্রেসিংরুমের কোণের চেয়ারটায়। পাশের ঘরে তখন সিলেকশন কমিটির মিটিং চলছিল। পাণ্ডুরং সালগাঁওকর না আনন্দ ব্যানার্জি, কে খেলবে? ঘরের আর এক কোণে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে পাণ্ডু একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে। দুজনের মনে একই চিন্তা, কে বাদ যাবে। পতৌদির নিথর ডান চোখ কিছুক্ষণ গেঁথে রইল আনন্দর মুখে, তারপর পিঠে চাপড় দিয়েই তাকাল সালগাঁওকরের দিকে।
সরি পাণ্ডু।
সালগাঁওকরের মুখটা কিছুক্ষণের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে রইল। বহুদিন ধরেই তার নাম আলোচিত হচ্ছে ভারতের সম্ভাব্য ওপেনিং বোলার হিসাবে। আজকের টাইমস অফ ইন্ডিয়ায়, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে, স্টেটসম্যানেও তাকে দলে নেবার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। সব কাগজই বলেছে, ব্যানার্জি বড্ড কাঁচা, এখনই বিশ্বের সেরা মারকুটে ব্যাটসম্যানদের সামনে ওকে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। যদি বেধড়ক মার খায় তা হলে কেরিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। সকালে কাগজে এইসব পড়তে পড়তে আনন্দ নিশ্চিত হয়ে গেছল এগারোজনের মধ্যে তার জায়গা হবে না। তাই পতৌদির বাড়ানো হাতটা ধরতে ভুলে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে রইল। সেই সময় সালগাঁওকরই এগিয়ে এসে তার বিরাট মুঠোয় আনন্দর ডান হাতটা ধরে বলল, আমি কিছু মনে করছি না। কেউ একজন তো বাদ যেতই। তোমার বদলে আমি হলাম। তুমি সাকসেসফুল হও এটাই চাই।
অনেকেই কনগ্রাচুলেট করে গেল। আনন্দ শুধু থ্যাংক ইউ বলা ছাড়া আর কোনও কথা মুখ দিয়ে বার করতে পারল না। অবশ্য বলার আছেই বা কী। সকলেই বয়সে বড়। ওরা পরস্পরকে ডাকে অদ্ভুত সব ডাকনামে—ভেঙ্কটরাঘবন ভেঙ্কি, বিশ্বনাথ ভিশ, সুনীল গাভাসকর সানি, একনাথ সোলর একি, প্রসন্ন প্রাস এইরকম আর কী। মেজদা বলে দিয়েছে, ওরা তোমার থেকে অনেক বড়। ছোট ছোটর মতোই থাকবে।
আর ঠিক আধঘণ্টা বাকি ফিফথ টেস্ট ম্যাচ শুরু হতে। আনন্দ ড্রেসিংরুম থেকে নেমে এল মাঠে। নতুন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম। ইডেনের মতো অত বড় নয়। নেট-প্রাকটিস করছে দুটো টিমই। গিবস, বয়েস, সোবার্স বল করছে। কালীচরণ নেটের মধ্যে।
ইন্ডিয়ান নেটে ফারুক। একটা বল নিয়ে মিডিয়াম-পেসে আনন্দ বল করল কয়েকটা। ব্রিজেশ, মাঁকড় আর সোলকর অর্ধচন্দ্রাকারে দাঁড়িয়ে, ক্যাচিং প্র্যাকটিস করাচ্ছে প্রসন্ন। আনন্দ গিয়ে দাঁড়াল ব্রিজেশের পাশে। মালীরা এসেছে নেট তোলবার জন্য। পতৌদি আর লয়েড টস করতে নামছে। গেস্ট ব্লকে মেজদা বসে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বোম্বাই এসেছে। কাল রাত্রে হোটেলে দেখা করে শুধু বলেছিল, আনন্দ, ঘাবড়াচ্ছিস?
ঘাবড়াব কেন, তবে বুকের মধ্যে—
মেজদা হাসিমুখে বলেছিল, সব অসুখই সারে। তুইও সেরে উঠবি।
পতৌদি টসে জিতেছে। কিন্তু ইন্ডিয়া ব্যাট করছে না। রবার্টস, সোবার্স, বয়েসের কথা ভেবে, তাজা পিচ ওদের হাতে তুলে না দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই ছেড়ে দিয়েছে আনন্দর বলের সামনে।
আনন্দর হাতে বল। জীবনের প্রথম টেস্টের প্রথম ওভার। ফ্রেডেরিকস গার্ড নিয়ে ক্রিজে আঁচড় কাটছে। পতৌদি ফিল্ড সাজাচ্ছে।
গালিকে ফোর্থ স্লিপ করে দেব?
আনন্দ বোকার মতো মাথা নাড়ল।
থার্ডম্যান রাখার দরকার আছে?
আনন্দ আবার মাথা নাড়ল।
পতৌদি আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে ফিল্ড সাজাল। গাড়েওয়ার প্যাভিলিয়নের দিকে চব্বিশ স্টেপ নিয়ে বুটের স্পাইক দিয়ে ঘাসে আঁচড় কাটার পর আনন্দ মুখ তুলেই দেখল গ্যালারিতে দুটো টি ভি ক্যামেরা—এখন হয়তো তাকেই তাক করে আছে। আনন্দর বুক ঢিবঢিব করে উঠল। সে তাড়াতাড়ি ঘুরে গিয়ে ব্যাটসম্যানের দিকে তাকাল। তখন ফ্রেডেরিকস পিছনটা একবার দেখে নিয়ে স্টান্স নিল।