থার্ড সেট।
১–১; ২-২; ৩৩; ৪৪; ৪–৫। আনন্দ পিছিয়ে গেছে।
কোনর্সের সার্ভিস এবার। আগের গেমে প্রচণ্ড খেলে আনন্দর সার্ভিস ভেঙে সে এগিয়ে এসেছে ৫৪ হয়ে। আনন্দ চারদিকে তাকাল। মুখগুলো উত্তেজনায় টসটস করছে। ঠাসাঠাসি ভিড়ে লোক উপচে পড়ছে স্ট্যান্ড থেকে।
লড়ে যা বাঙালি।
একটা তীক্ষ্ণস্বর বাংলা শব্দগুলোকে সেন্টার কোর্টের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আনন্দ একবার তাকাল স্ট্যান্ডের দিকে।
কোনর্স সার্ভ করছে। বলটা জমিতে ছোবল দিয়ে বেরিয়ে গেল।
ফিফটিন লাভ।
মাথা ঠাণ্ডা রাখো, আনন্দ। জয় মুঠোয় আসতে এখনও অনেক পয়েন্ট বাকি। কোনর্স দারুণ লড়তে পারে। আলগা দিয়ো না।
বাঁ হাত কোমরে রেখে র্যাকেট ধরা ডান হাতটা ঝুলিয়ে আনন্দ, যেন ম্যাচ খেলছে না, খেলা দেখছে এমন উদাসীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ক্লাব-টুর্নামেন্টের মতো যেন ব্যাপারটা। কোনর্স দুই আঙুলে ভি দেখাল। ভিকট্রি? আনন্দর ঠোঁট তাচ্ছিল্যে মুচড়ে গেল।
সার্ভিস করেছে কোনর্স, প্রচণ্ড জোরালো। আনন্দ র্যাকেট ঠেকাতেই, থার্ডম্যানের দিকে ক্যাচ ওঠার মতো বল ছিটকে স্ট্যান্ডের দিকে চলে গেল।
কাম অন্ ব্যানার্জি।
থার্টি-লাভ টু কোনর্স।
বাঙালি জা-গ-ও।
আনন্দ হেসে ফেলল।
হচ্ছে কী আনন্দ। স্টেডি স্টেডি।
প্লিজ রিফ্রেন ফ্রম এনি রিমার্কস।
নাসতাসে ডান হাতের ঘুষি বাঁ হাতের তালুতে মারছে। কোনর্স ভি দেখাল মুখ ভেঙচে। আনন্দ আড়চোখে লক্ষ করল, রোজওয়াল তার দিকে তাকিয়ে। কী বিষণ্ণ দুঃখী চাহনি। বুকটা মুচড়ে উঠল আনন্দর। ঘাবড়াচ্ছ কেন! তুমি নিশ্চিত থাকো, আমিই ফাইনালে যাব। সেখানে তুমি আমাকে হারাবে।
কোনর্সের সার্ভ। আনন্দ প্রচণ্ড ফোরহ্যান্ড মারল। নেট ঘেঁষে সাইড লাইন ছুঁয়ে বল বেরিয়ে গেল।
থার্টি-ফিফটিন।
কোনর্স সার্ভ করল। দুর্দান্ত ব্যাকহ্যান্ড রিটার্ন তার বাঁ দিকে।
থার্টি—অল।
এবারের সার্ভিসটাও দারুণ রিটার্ন করল আনন্দ। ডাউন দ্য লাইন বেরিয়ে গেল পনেরো হাজার লোককে চমকে দিয়ে। তারপর উচ্ছ্বাসের বিরাট একটা শব্দে সেন্টার কোর্ট কেঁপে উঠল। আনন্দ গেমটা জিতেছে। এখন ৫৫।
সেটটা জিতলেই ম্যাচটাও জেতা হয়ে যাবে। ক্লান্ত বোধ করল আনন্দ। এখনি জিতে কী লাভ! আকাশ জুড়ে গনগনে কারখানার ফার্নেসের মতো তাপ ছড়িয়ে। ফার্নেসের খোলা দরজাটার মতো সূর্য। গরমে ঘামে এক ধরনের আলস্য আনন্দের চোখে জড়িয়ে এল।
ফাইনালে রোজওয়ালের কাছে কি হেরে যাব? ইন্ডিয়াকে এত বড় সম্মান থেকে বঞ্চিত করব? কৃষ্ণণ দুবার সেমিফাইনালে উঠেছে। ব্যস, তারপর এই আনন্দ ব্যানার্জি। টেনিসের সব থেকে বড় সম্মান মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দেব? ভারতের ষাট কোটি লোেক কী দারুণ আশা নিয়ে অপেক্ষা করবে রেডিয়োয় কান পেতে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিড়। পটকা-বোমা নিয়ে নেতাজি পার্কে আড্ডা দেওয়া ছেলেগুলো চেঁচাচ্ছে—আন্দো রে আন্দো, ওই যে ফাস্ট বল করত, নেটে একদিন মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল একটা ছেলের। শান্ত চুপচাপ থাকত। ও যে এমন টেনিস খেলে! হোক না বটতলার ছেলে, আমাদেরই পাড়ার। পটকা ফাটাবার জন্য ওরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করবে। মেজদা তো অফিসই যাবে না। বাবা অবশ্য ঠিকই বেরোবে, চেম্বারেও বসবে। হাবুর মা বার বার হয়তো বিপিনদাকে জ্বালাবে—হ্যাঁ গা, আমাদের আন্দো সাহেবের সঙ্গে কীসের লড়াই করতে গেছে? ছেলেটা বড় দুবলা, পারবে তো? আর অমল কী করবে!
জানে, একমাত্র অমলই জানে কেন আমি ফাইনালে উঠতে চেয়েছিলাম। ফাইনালে কী রেজাল্ট হবে তাও জানে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর খেলতে খেলতে রোজওয়ালের মুখে ছাপ পড়ে গেছে চিন্তার, উদ্বেগের। চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে গেছে। মুখের চামড়া খসখসে মোটা আলগা হয়ে এসেছে। শরীর আর কুড়ি বছর বয়সের মতো ধকল নিতে পারে না। কী কষ্ট করে একটা লোককে সারা পৃথিবীর সেরাদের চ্যালেঞ্জ ঠেলে বাইশ বছর টিকে থাকতে হয়েছে। টেনিসের সব সম্মানই পেয়েছে শুধু সেরা সম্মানটি ছাড়া। একেই বলে বরাত! সেই বরাতকে কি হারানো যায় না?
একদিকে ষাট কোটি আর একদিকে মাত্র একজন। শ্রীকৃষ্ণ হলে কী করতেন? রোজওয়াল কি অর্জুন! যদি হেরে যাই তাহলে পরের বছর কিংবা তার পরের বছর জিততে পারি। কিন্তু রোজওয়াল আর পারবে না।
ষাট কোটি লোকের এত আশা, এত আকাঙ্ক্ষা চুরমার করে দেব, একজনের জন্য? অমল কি এই বিদঘুটে সমস্যাটার কথা ভেবেছে কখনও? একটা এত বড় দেশ, মানসম্মান কখনও পায়নি, শুধুই পিছনে, সকলের পিছনে। সারা পৃথিবী ভুলেই গেছে। এত বড় একটা দেশ স্পোর্টস জগতে আছে; দেশটার মানুষও ভুলে গেছে খেলাধুলায় তারা কিছু করতে পারে। হারের পর হার দেখতে দেখতে নুয়ে পড়েছে, বিশ্বাস করছে তারা অপদার্থ তাদের, দ্বারা ফাস্ট বোলিং হবে না, টেনিস চ্যাম্পিয়ন সম্ভব নয়। এই দেশটা চমকে জেগে উঠে শিরদাঁড়া সোজা করে তাকাবে যদি আনন্দ উইম্বলডন জেতে। ষাট কোটি মানুষ, ভাবা যায়! আর তার বদলে একজনের, মাত্র একজনের সাধ কিংবা বলা যায় শখ, মেটাবার জন্য এত মানুষকে ডুবিয়ে দেওয়া! কী করব এখন? দেশের জন্য না নিজের জন্য? বেচারা রোজওয়াল, কী সাধনা, মনের জোর—এসব কি ব্যর্থ হবে শেষ পর্যন্ত? দেশ বড় না একটা লোক বড়?