বলটা শূন্যে ছুড়ে র্যাকেটের ঘা দিল আনন্দ। সাইড লাইন আর সার্ভিস লাইনের কোনায় পড়ে কোর্নসের ব্যাকহ্যান্ডের নাগালের বাইরে দিয়ে বল বেরিয়ে গেল।
ফিফটিন-লাভ।
বাঁ দিকের কোর্টে সরে এল আনন্দ। ধীর মন্থর অলস তার হাঁটার ভঙ্গি। যেন ক্লাব টুর্নামেন্টে প্রথম রাউন্ড ম্যাচ খেলছে কোনও শিক্ষার্থীর সঙ্গে।
সার্ভ করল আনন্দ।
সেই একই জায়গায় বল পড়ল। মসৃণ অথচ তীব্রবেগে। জিমি ডান দিকে ঝাঁপিয়ে ব্যাক হ্যান্ডে কোনওরকমে র্যাকেট ছোঁয়াল। উঁচু হয়ে বলটা উঠল। হঠাৎ গুডলেংথ থেকে লাফিয়ে ওঠা বলে ব্যাট পাতলে সিলি মিড অনের মাথার ওপর যেরকম ক্যাচ ওঠে। সার্ভিস করেই আনন্দ ছুটে এসেছিল নেটের দিকে। জিমি বেস লাইনের ওপর অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে দেখছে বলটা নেটের ওপর আলতোভাবে নামছে। বাঁ হাত কোমরে রেখে অতি অবহেলায় আনন্দ ফাঁকা কোর্টের আর একপ্রান্তে ভলি মারল। খুব আস্তে টুং করে। ফিরে তাকালও না আর। যেন, এ তো জানা কথাই পয়েন্ট পাব! তারপর আবার সারভ করার জন্য আলস্যভরে বেস লাইনের দিকে যেতে যেতে বলবয়ের ছুড়ে দেওয়া বল থেকে একটা লুফে নিল।
মাইক্রোফোনে আম্পায়ারের গলা: থার্টি-লাভ।
আবার প্রচণ্ড সার্ভিস সেন্টার লাইনে খড়ির দাগ একটা জায়গায় হালকা ধোঁয়ার মতো উড়তে দেখা গেল। এস! দাগের ওপর বল পড়েছে। চারদিকের স্ট্যান্ডে গুঞ্জন উঠেই মিলিয়ে গেল। জিমি লাইনের দিকে তাকিয়ে দুহাত মুঠো করে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করল। সয়্যার করছে। গালাগাল দিচ্ছে। দিক। দিতেই হবে। জবাব দেবে কী করে এইরকম সার্ভিসের!
ফর্টি-লাভ।
কী যেন বলেছিল জিমি রিপোর্টারের কাছে?—আই অ্যাম গেটিং বেটার। আই নাউ হ্যাভ মোর শটস। দেয়ার ইজ নো প্রেশার অন মি। আত্মম্ভরিতা। ঠাণ্ডা মেজাজে, আনন্দ, ঠাণ্ডা মেজাজে খেলে যাও। পৃথিবীর একনম্বর তোমার সামনে। কাল রাত্রে যেমনই ছকে রেখেছ, ঠিক সেইভাবে বরফের মতো মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলে যাও। মন্থর করো খেলাটাকে। জিমিকে নেটে আসতে দিয়ো না, তা হলে তোমায় খুন করে ফেলবে। বেস লাইনে ঠেলে রাখো ওকে। তুমি যত মারবে, ততই ওর সুবিধা, যে ব্যাটসম্যানের হাতে স্ট্রোক আছে, ফাস্ট পিচ তাকে খুশি করে। কোনর্সের হাতে সবরকম মার আছে। মনে আছে উইম্বলডন-বিজয়ীদের নাম লেখা বিরাট বোর্ডটার ওপরে কিপলিংয়ের লাইনটা? যখন সবাই তোমার সম্পর্কে সন্দিহান তখন যদি নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে পারো…
বিশ্বাস রাখো, আনন্দ। তুমি পারবে। পারবে। পারতেই হবে, কেননা
সার্ভ করল আনন্দ।
বলটাকে ফোরহ্যান্ডে কোনর্স পেয়ে গেছে। আনন্দর ডানদিকে রিটার্নটা এল। সাইড লাইন বরাবর সে ফোরহ্যান্ডে মারল। কী অবিশ্বাস্য কোনর্সের ছোটা। নিমেষে বলের কাছে পৌঁছেছে। বিদ্যুৎগতি ক্রসকোর্ট শট এল আনন্দর ব্যাকহ্যান্ডে। বলটা সে কোনর্সের কোর্টের মাঝামাঝি মারল। এইবার দু-হাতে র্যাকেট ধরে ভয়ঙ্কর ব্যাকহ্যান্ড মারবে ও।
কোনর্স মারল, এবং আনন্দ ঠিক সেইখানেই, যেখানে বল এল। যেন ও আগে থেকে জানত। স্টপ-ভলি করল আনন্দ সামান্য ঝুঁকে। কোনর্স ছুটে এসে চেষ্টা করল পাসিং শট। আনন্দর লম্বা হাতে বাড়ানোে র্যাকেট বিদ্যুৎগতিতে বলটাকে মাঝপথে আটকে দিয়ে ফেরত পাঠাল কোনর্সের কোর্টে। নেটের কাছে দাঁড়ানো কোনর্স অসহায় ভাবে পিছনে তাকিয়ে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো মাটিতে পা ঠুকল।
ফাস্ট গেম টু ব্যানার্জি।
এবার কোনর্সের সারভিস। বিনীত মৃদু ভঙ্গিতে আনন্দ অতিরিক্ত বলগুলো যেভাবে নেট থেকে ব্যাট দিয়ে মেরে বোলারের কাছে ফেরত দেয় সেই ভঙ্গিতে এক এক করে র্যাকেটে মেরে ধীরে ধীরে পাঠিয়ে দিল কোর্সের কোর্টে। কোনর্সের বন্ধু নাসতাসে হাত মুঠো করে ঝাঁকাচ্ছে। ন্যাস্টি উৎসাহ দিচ্ছে।
আনন্দ তাকাল আম্পায়ারের পিছনে স্ট্যান্ডের দিকে। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির ছোট্টখাট্ট একটা মানুষ, সঙ্গে স্ত্রী আর দুই ছেলে। বাইশ বছর আগে, আনন্দর জন্মেরও আগে প্রথম এখানে খেলেছে। আজও জিততে পারেনি। এবারের ফাইনালে কোনর্সের মুখোমুখি হলে কোনর্স ওকে খেয়ে ফেলবে। হয়তো কোনওদিনই আর জেতা হবে না।
চোখাচোখি হল। আনন্দ মাথা ঝুকিয়ে নমস্কার জানাল। রোজওয়াল মাথাটা সামান্য পাশে হেলাল। চোখে চাপা হাসি। অন্যদিক থেকে রোজওয়াল এবারেও ফাইনালে উঠেছে সেমি ফাইনালে নিউকোমবকে হারিয়ে। আনন্দর মনে হল, সে ওর ছেলের বয়সী।
কোনর্স সারভিস শুরু করতে যাচ্ছে
আগুন, আগুন, আগুন।
.
খাটের ওপর উঠে বসল আনন্দ। পুবের জানলা দিয়ে যতটা সম্ভব দেখার চেষ্টা করল। মাঠের ওপর দিয়ে কারখানার কয়েকটা লোক ছুটে গেল। হইচইয়ের আওয়াজে মনে হচ্ছে আগুন কারখানাতেই লেগেছে।
দেখার জন্য আনন্দ ফটকের কাছে আসতেই বিপিনদার ধমক খেল।
দেখতে হবে না। যাও, ঘরে যাও। সামান্য আগুন, নিভিয়ে ফেলেছে।
খেলার মধ্যে হঠাৎ বাধা পড়ায়, আনন্দ আর মেজাজ পাচ্ছে না। বিছানায় শুয়ে ঘড়ি দেখল। দুপুর দেড়টা। প্রথম সেটটা সে পর পর কোনর্সের তিনটে সার্ভিস ভেঙে নিয়ে নিল ৬–০ গেমে। আধমিনিটের মধ্যেই ব্যাপারটা চুকে গেল।
এবার দ্বিতীয় সেট।
.
সময় নষ্ট করে লাভ কী! এবারে ৬—১। তিনবার ডিউস হয়েছে। একটা গেম নিশ্চয়ই কোনর্স নেবে। অতবড় প্লেয়ার…৬-২ হতে পারে। দুটো গেম নিলে কী এসে যায় তার। লন্ডনে নিশ্চয়ই প্রচুর ইন্ডিয়ান আছে। বাঙালিও আছে। যারা লর্ডসে গিয়ে অপমানে খেপে, লজ্জায় মাথা নামিয়েছিল ৪২ রানের ইনিংস দেখে, তারা নিশ্চয় উইম্বলডনে এসেছে।